রাশিয়া থেকে তেল কেনার অপরাধে বুধবার (৬ অগাস্ট) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের ওপর যে বাড়তি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন সেই ধাক্কা থেকে দিল্লি এখনো বেরোতে পারেনি। ভারতীয় পণ্যের ওপর এখন মোট মার্কিন শুল্ক হতে যাচ্ছে ৫০ শতাংশ। আগামী ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
এই পদক্ষেপকে ভারত সরকার বিবৃতি দিয়ে ‘অন্যায়’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলে বর্ণনা করেছে এবং বিশ্লেষকরা সবাই প্রায় একবাক্যে বলছেন, ভারতের রফতানিমুখী বাণিজ্য ও সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর এত বড় আঘাত স্মরণকালের মধ্যে আসেনি।
ভারত ছাড়া এশিয়ার আর কোনো দেশে এত চড়া হারে মার্কিন শুল্ক বসানো হয়নি। বস্তুত এই ৫০ শতাংশ হার ভারতকে এনে ফেলেছে ব্রাজিলের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে -লাতিন আমেরিকার যে দেশটির সঙ্গে আমেরিকার রীতিমতো ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে।
ভারত এই মুহুর্তে বছরে প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য আমেরিকায় রফতানি করে থাকে। ট্যারিফের এই হার বজায় থাকলে তার প্রায় পুরোটাই বাণিজ্যিকভাবে ‘আনভায়াবেল’ হয়ে পড়বে- মানে অন্য দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারত টিকে থাকতে পারবে না।
বেশির ভাগ ভারতীয় রফতানিকারকই জানিয়েছেন, তারা বড়জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্কবৃদ্ধি ‘অ্যাবসর্ব’ করতে পারবেন ফলে ৫০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কা সামলানো তাদের জন্য কার্যত অসম্ভব এবং পথে বসার সামিল।
রফতানিতে যে ধরনের প্রভাব পড়বে
জাপানি ব্রোকারেজ ফার্ম নোমুরা এই কারণেই তাদের একটি নোটে উল্লেখ করেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আসলে ভারতের বিরুদ্ধে একটি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার (ট্রেড এমবার্গো) মতো বিষয়- যা বহু ভারতীয় পণ্যের রফতানি একেবারে রাতারাতি বন্ধ করে দেবে।
বহু বছর ধরে আমেরিকাই হলো ভারতের প্রধান রফতানি বাজার- ভারতের মোট রফতানির ১৮ শতাংশই যায় মার্কিন মুলুকে, ভারতের মোট জিডিপির ২.২ শতাংশ আসে আমেরিকার বাজার থেকে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন প্রথমে ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানোর কথা বলেছিলেন, তখনই ধারণা করা হয়েছিল জিডিপি ০.২ থেকে ০.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং প্রবৃদ্ধির হারও ৬ শতাংশর নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
এখন ট্যারিফ বেড়ে ৫০ শতাংশ হওয়ায় এই ধাক্কা হতে চলেছে আরও বহুগুণ। ভারতের ইলেকট্রনিকস ও ফার্মা রফতানিকে অবশ্য আপাতত অতিরিক্ত শুল্কের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
তবে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কনসালটেন্সি ‘এশিয়া ডিকোডেড’-এর প্রিয়াঙ্কা কিশোর বিবিসিকে বলছেন, টেক্সটাইল ও জুয়েলারির (রত্ন ও স্বর্ণালঙ্কার) মতো যেসব রফতানি পণ্য খুব ‘শ্রম-নিবিড়’ (লেবার ইনটেনসিভ), দেশের অভ্যন্তরে সেই শিল্পগুলোতে আমেরিকার শুল্কের প্রভাব পড়বে মারাত্মক।
তামিলনাডুর তিরুপুরে তৈরি পোশাক কারখানায় কিংবা গুজরাটের সুরাটে হীরের গয়না বা স্বর্ণালঙ্কারের কারখানায় বহু শ্রমিক হয়তো কাজ হারাবেন, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানই মুখ থুবড়ে পড়বে।
কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির রাকেশ মেহরাও স্বীকার করছেন, মার্কিন বাজারে ভারতীয় টেক্সটাইলের যে কম্পিটিটিভনেস ছিল, সেটাই এবার অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে তারা খোয়াতে বসেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এই অবধারিত বাণিজ্যিক বিপর্যয় সামলানোর জন্য ভারতের হাতে আদৌ কি কোনো উপায় আছে?
৫০ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর হওয়ার কথা আর মাত্র ১৯ দিনের মধ্যেই, এত অল্প সময়ের মধ্যে দিল্লি সত্যিই কতদূর কী করতে পারে?
কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ ভারতের সামনে তাদের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার একটা অযাচিত সুযোগ এনে দিয়েছে।
দিল্লির প্রথম সারির থিংকট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) অজয় শ্রীবাস্তবের ধারণা, আমেরিকার এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারত অবশ্যই তাদের স্ট্র্যাটেজিক অ্যালাইনমেন্ট বা কৌশলগত সমীকরণগুলো নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এরপর রাশিয়া, চীন ও অন্য আরও অনেক দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর হতে চলেছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সামনেই চীনে অনুষ্ঠিতব্য সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চলেছেন ২০২০ সালে গালওয়ান ভ্যালিতে চীনা ও ভারতীয় সেনার মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এই প্রথমবার।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই ধারণা করছেন, এই সম্মেলন থেকেই রাশিয়া-ভারত-চীন একটি ত্রিপাক্ষিক আলোচনা বা অ্যাক্সিসের (অক্ষ) সূচনা হতে পারে।
দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ তথা দক্ষিণপন্থি চিন্তাবিদ শুভ্রকমল দত্ত বিশ্বাস করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ঔদ্ধত্য’ এই নতুন অক্ষ তৈরির পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ট্রাম্পের সমস্যা তো শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, দেখা যাচ্ছে কানাডা, ন্যাটো, চীন, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা, আসিয়ান বা মধ্যপ্রাচ্য সবাইকে ভয় দেখিয়ে তিনি নিজের পথে আনতে চেষ্টা করেছেন।
বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার এ ধরনের পদক্ষেপই হয়তো কাজে আসতো, কিন্তু এই একুশ শতক একটা নতুন শতক, যেখানে গ্লোবাল অর্ডারটাই আলাদা এখন আর ওভাবে ভয় দেখিয়ে কোনো কাজ হবে না।
রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো তিনটি শক্তিকে আলাদাভাবে ‘বুলডোজ’ করতে গিয়ে তিনি এই তিন দেশকেই আসলে কাছাকাছি নিয়ে এসে একটা ‘ট্রয়কা’ তৈরির রাস্তা সুগম করে দিচ্ছেন বলে শুভ্রকমল দত্ত মনে করেন।
তিনি বলেন, এটাও ঠিক যে চীন ও ভারতের মধ্যে এখনও অনেক বিরোধ ও সমস্যা আছে। আর এরকম কোনো ত্রিভুজ তৈরি হলেও সেটা যে কোনো লাভ ট্রায়াঙ্গেল হবে না এটাও আমরা জানি। কিন্তু অভিন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেদের সারভাইভাল বা অস্তিত্ত্বের তাগিদই তাদের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ