ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের কিছু শীর্ষ কর্তা বিতাড়িত হলেও তাদের অধিকাংশ সহযোগীই বহাল তবিয়তে রয়েছেন নানা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী পদে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কর্মসংস্থান ব্যাংক এর ব্যতিক্রম নয়। অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকটির শীর্ষ পদের প্রায় সব ক’টিতেই ফ্যাসিবাদের সাথে সরাসরি জড়িতরাই দাপটের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের ফ্যাসিবাদি আচরণে এখনো অতিষ্ঠ ব্যাংকটির সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ফ্যাসিবাদের সাথে জড়িতরা এখনো ব্যাংকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি ফ্যাসিস্টদের পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানের ১০ মাস পরও ফ্যাসিবাদিদের ব্যাংকটির শীর্ষ পদে বহাল থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভ ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলছেন, ফ্যাসিবাদিদেরকে ব্যাংকটির শীর্ষ পদ থেকে বিদায় করা না হলে তারা কর্মবিরতিসহ আন্দোলনের ডাক দিবেন।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কর্মসংস্থান ব্যাংকে ফ্যাসিবাদের দোসররা নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের নানা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। ব্যাংকের বর্তমান এমডি অরুন কুমার চৌধুরী বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ বিতাড়িত হওয়ার পরেও তিনি কর্মসংস্থান ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পদায়ন করে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। একইসাথে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদেরকে প্রধান কার্যালয় অথবা ঢাকা থেকে দূরবর্তীস্থানে বদলী করে শাস্তি প্রদান করছেন। অনেকেরই পদোন্নতি আটকিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কর্মসংস্থান ব্যাংক বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি ও ফ্যাসিবাদের দোসর ডিজিএম মনোজ রায় এখনো ব্যাংকের হর্তাকর্তা। তার পরামর্শ ও নির্দেশনায় বর্তমান প্রশাসন ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারীদেরকে দূরবর্তী স্থানে বদলী করেন এবং ফ্যাসিবাদের দোসর, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও আওয়ামী সর্মথকদেরকে ঢাকায় এবং প্রধান কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাসন করেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে পাহাড়সম অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও এখনও তিনি আগের ক্ষমতায় বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। ব্যাংকের সার্বিক ক্ষমতা যেন তার হাতেই। বর্তমান এমডির সাথে তার সখ্যতার কারণে তিনি ব্যাংকে সকল কর্মকান্ডে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকের জিএম (নিরীক্ষা মহাবিভাগ) আমিরুল ইসলাম , যিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির নির্বাহী সদস্য। একইসাথে আওয়ামী ফোরামের সমর্থন নিয়ে অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি পট পরিবর্তনের পর নিজেকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী পরিচয় দিয়ে পদোন্নতি নিয়ে ব্যাংকে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছেন। তার কার্যক্রমে আওয়ামী বিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো তটস্থ থাকেন। অনেকেই বলেছেন, ব্যাংকে যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের পুনর্বহালের দায়িত্ব তিনি পালন করছেন। বেশ কিছুদিন আগে অফিসার্স সমিতি মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার কার্যালয়ে গিয়ে বক্তব্য নেযার চেষ্টা করা হলেও তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে সক্ষিাৎ দেননি।
জানা গেছে, ব্যাংকের চেয়ারম্যান এর পিএস মোহাম্মদ আবুল বাশার ফ্যাসিবাদের দোসর ও আওয়ামী পরিবারের সদস্য। অভিযোগ রয়েছে, তিনি সাবেক রেলমন্ত্রী মজিবুল হক এর নিকটাত্মীয় ও রেলমন্ত্রীর এপিএস জামাল হোসেন পাটোয়ারী এর চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে তাদেরকে ব্যবহার করে তিনি প্রধান কার্যালয়ে পোস্টিং নেন। পরবর্তিতে ফ্যাসিবাদের দোসর মনোজ রায় ও অন্যদের যোগসাজসে তাকে চেয়ারম্যান এর পিএস হিসেবে পদায়ন করা হয়। তিনি চেয়ারম্যানের ক্ষমতা ব্যবহার করে এমডি’র নিকট থেকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। জানা গেছে, তিনি অনৈতিকভাবে ব্যাংক থেকে হাউজ লোন নিয়েছেন। তিনি ২০১৬ সালে জয়েন করে গেল অর্থবছরে অনৈতিকভাবে হাউজ লোন নিয়েছেন। অথচ গেল বছরে ২০১৩ সালে জয়েনকারীরাও সবাই হাউজলোন নিতে পারেননি।
অনেকেই অভিযোগে জানান, ফ্যাসিবাদবিরোধীদের দমন করার জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক বঙ্গবন্ধু পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম কে এমডি’র পিএস হিসেবে পদায়ন করা হয়। এরপর থেকেই বদলী পদায়ন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে তিনি অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন বলে তারা জানান। এছাড়া ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ফ্যাসিবাদের দোসর ইমরুল হাসান অপু ছাত্র জীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তার আপন দুইভাই টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। তার শ্বশুর এস এম মতিয়ার রহমান তালুকদার (মন্টু) টাঙ্গাইল এর ৮ নং রাঘিল ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামীলীগের ব্যানারে চেয়ারম্যান হয়েছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আব্দুর রাজ্জাকের সুপারিশে তিনি কর্মসংস্থান ব্যাংকের চাকুরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং আব্দুর রাজ্জাকের তাৎক্ষনিক ফোনে তাকে টাঙ্গাইল শাখা হতে প্রধান কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পিআরও পদে থেকে পরোক্ষভাবে তিনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিভিন্ন প্রচারনা করেন। বিজ্ঞাপন প্রদানসহ নানাভাবে আওয়ামী ঘরানার মিডিয়াকে সহযোগিতা প্রদান করতেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এখনও আওয়ামী পন্থি মিডিয়াকেই তিনি বিজ্ঞাপন দিয়ে সহযোগিতা করছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে কর্মরত ডিজিএম মুখলেছুর রহমান এর পূত্র জামালপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন দূর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান (বর্তমানে অপসারিত) ও শীর্ষ একাধিক আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা এ তথ্য জেনে মুখলেছুর রহমানকে তার পুত্রের বিষয়ে সতর্ক করে আন্দোলন হতে সরে আসার জন্য চাপ দেন এবং মুখলেছুর রহমানকে রাজশাহীতে বদলী করে শাস্তি প্রদান করেন। মুখলেছুর রহমান এর স্থলে রাজশাহীর প্রাক্তন ডিজিএম বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রভাবশালী ও নেতৃত্বদানকারী সিনিয়র সদস্য মুহাম্মদ আকতার হোসেন প্রধানকে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। আকতার হোসেন প্রধান সরাসরি ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হোসেন মাহমুদ আলীর নিকটাত্মীয়। সূত্র মতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারীদেরকে দমন করার জন্য বঙ্গবন্ধু পরিষদ সমর্থিত প্যানেলের বিরোধী প্যানেল হতে নির্বাচিত অফিসার্স এসোসিয়েশন এর কার্যকরি সভাপতি ডিজিএম মমতাজ উদ্দিনকে চট্টগ্রামে বদলী করে তার স্থলে বঙ্গবন্ধু পরিষদ প্রভাবশালী সদস্য আকতার হোসেনকে প্রধান কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। তিনি মনোজ রায় এর সাথে যোগসাযোগে প্রধান কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলন দমন করার জন্য ব্যাংকের শীর্ষ পদে থাকা কর্তা ব্যক্তিরা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারীদেরকে দূরবর্তী স্থানে বদলী করে ফ্যাসিবাদের দোসর ও বঙ্গবন্ধু পরিষদ সদস্য মনীষা রানী দে, ঝর্ণা রায়, রুম্পা রানী সেন গংদেরকে প্রধান কার্যালয়ে পদায়ন করেন। ফ্যাসিবাদের দোসর ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের অন্যান্য সক্রিয় কর্মীদের মধ্যে এমডি’র দপ্তরে কর্মরত ফয়সাল আহমেদ, কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে কর্মরত আসাদুজ্জামান কবি, নিরীক্ষা বিভাগে কর্মরত মোঃ শহিদুজ্জামান খান, প্রধান শাখা, ঢাকায় কর্মরত মোঃ রাশেদুল ইসলাম, এজিএম আবু সাঈদ, আবদুস সালাম, আলমগীর কবির, খালেদ জাহাঙ্গীর, মো: শোয়েব, ইমতেয়াজ হায়াত খানসহ আরো অনেকে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। এ সকল স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসরদেরকে প্রধান কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পদ হতে সরানো না হলে স্বৈরাচারী আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়ন হওয়ার ও জনগণের এ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকটির ভবিষ্যত মারাত্মক হুমকির মূখে পড়ার আশংকা রয়েছে বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান।
এদিকে ফ্যাসিবাদের সাথে জড়িত ছিলেন বলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের কেউকেউ এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা ফ্যাসিবাদের দোসর ছিলেন না। তাদের নাম কমিটিতে রাখা হয়েছে, যেটি তারা জানতেন না। আবার অনেক কর্মসূচিতে তাদের অনিচ্ছার বাইরে দলীয় ব্যানারে অংশ নিতে হয়েছে।
জানতে চাইলে কর্মসংস্থান ব্যাংকের সিবিএ’র (বিএনপি সমর্থিত) সাধারণ সম্পাদক কাজী নাছির উদ্দিন বলেন, গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে অনেকেই বাধ্য হয়ে কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। আমরা অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। তিনি বলেন, যারা ফ্যাসিবাদের দোসর ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখনো যে কেউ নেই সেটি বলব না, তবে তারা কোনো ক্ষতির কারণ হচ্ছেন না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অরুণ কুমার চৌধুরী বলেন, ফ্যাসিবাদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে তাদের নিয়ে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও তারা ব্যাংকের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ ছিলেন না। তিনি বলেন, এখন যারা ব্যাংকের শীর্ষ পদে ফ্যাসিবাদী রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন, তালিকায় তাদের অনেকের নামও আছে।
তিনি বলেন, অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে কোনো না কোনো সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকতে হয়েছে। তারপরও যারা ব্যাংকে ক্ষতিকর ছিল বলে মনে হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এখন যাদের বিরুদ্ধে াভিযোগ আনা হচ্ছে তাদের অন্যত্র বদলি করলে তখন তদারকি করা কঠিন হবে। প্রধান কার্যালয়ে থাকলে আমি মনিটরিং করতে পারবো।
তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অরুণ কুমার চৌধুরী বলেন, প্রত্যেক মানুষই একটি রাজনৈতিক আদর্শ লালন করে থাকেন। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমি আমার কর্মজীবনে কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকা-ে জড়িত হইনি। আওয়ামী সরকারের আমলে আমাকে একাধিকবার সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এখানে এমডি হিসেবে যোগদানের পর কেউ আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলাম, এর প্রমাণ দিতে পারবেন না। আমি পেশাদারিত্বের সাথে অতীতেও কাজ করেছি, এখনো করছি, ভবিষ্যতেও করবো।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ