ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ এবং গ্যাস-বিদূৎতের স্বল্পতায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে গ্যাসের চাপ না থাকলেও বিল দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি যথাসময়ে শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের চাপ রয়েছে। প্রশ্ন হলো ‘শিল্পমালিকরা উৎপাদন করতে না পারলে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেবেন কোথাথেকে? আর ঋণের সুদ পরিশোধই বা করবেন কীভাবে? এভাবে চলতে থাকলে কুরবানির ঈদের পর অনেক শিল্পকারখানাকে কুরবানি দিতে হবে। সব মিলে শিল্প ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
রোববার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট নিয়ে যেৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিটিএলএমইএ), বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশ (আইসিসি-বি)।
স্বাগত বক্তব্যে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘শিল্পের বর্তমান প্রেক্ষাপট বোঝাতে গেলে ১৯৭১ সালে ফিরে যেতে হবে। ‘৭১ সালে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছিল, ২০২৫ সালে একইভাবে শিল্প ও শিল্পোদ্যোক্তাদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে। এটা একধরনের ষড়যন্ত্রই মনে করি।
উদ্যোক্তারা গ্যাস না পেলেও বিল দিতে হচ্ছে, গ্যাসের অভাবে উৎপাদন প্রায় বন্ধ। অথচ ব্যাংক বলছে, তাড়াতাড়ি টাকা ফেরত দাও। সরকার বলছে, শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দাও। কারখানা চালাতে না পারলে উদ্যোক্তারা টাকা দেবেন কোত্থেকে। যারা ব্যাংক লুট করে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে মেৌজমাসি্ত করছে, ঘুরছে-ফিরছে, তাদের দায় এখন শিল্পমালিকদের বহন করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অস্ট্রিচ পাখি বিপদে পড়লে যেমন বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে রাখে, আমাদের উপদষ্টো সাহেবরাও অস্ট্রিচ পাখির মতো মাথা গুঁজে রাখায় চারদিকে কী হচ্ছে, তা তারা দেখতে পারছেন না। গ্যাস-বিদু্যতের অভাবে প্রতিনিয়ত কারখানা লে-অফ হচ্ছে। কিছুদিন পরে রাস্তায় মানুষ নামবে। আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। শিল্প না বাঁচলে দুর্ভিক্ষ হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যাবে।’
আক্ষেপ প্রকাশ করে রাসেল বলেন, ‘বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দেশি বিনিয়োগকারীদের সাপোর্ট দিতে পারছে না। আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে আসার বড় বড় গল্প শোনায়। পারলে বিদেশি একটা শিল্পপতিকে নিয়ে এসে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে দিক। গত ৮ মাসে তো ৮টাও বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।’
সরকার শিল্পবিরোধী নীতি গ্রহণ করছে মন্তব্য করে রাসেল বলেন, ‘বই ছাপানোর নামে ১০ হাজার টন কাগজ বিনা শুল্কে আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। আরও ৩০০ টন আমদানির চেষ্টা চলছে। এসব কাগজ এখন খোলা বাজারে দেশি কাগজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। এর মানে, সরকার পেপার মিলগুলো গলা টিপে মেরে ফেলছে। দেশে চিনির কল থাকার পরও চিনি আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। অর্থাৎ সরকারই শিল্পবিরোধী নীতি গ্রহণ করছে।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ১২ টাকার গ্যাস ৩০-৩১ টাকা করা হলেও কারখানায় গ্যাসের চাপ থাকছে না। আগের ফ্যাসিবাদী সরকার সদ্ধিান্ত নিয়ে শিল্পের ওপর চাপিয়ে দিল।
এতে শিল্প আস্তে আস্তে রুগ্ন হতে শুরু করছে। এরপর চাকরির জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য বৈষম্যবিরোধী বিপ্লব হলো। আমাদের মাঝে আশার আলো জাগল, হয়তো এবার ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব সঠিক নীতি গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম ঠিক এর উলটো। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কারখানায় গ্যাস দিচ্ছে না, ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে আবার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিচ্ছে। বেতন দিতে না পারলে আবার বিদেশ যাওয়া বন্ধের ধমক দেওয়া হচ্ছে, এটা কেন? সরকার তার কমিটমেন্ট রাখতে পারবে না। আর শিল্পোদ্যোক্তারা ইন্ডাস্ট্রি করার কারণে ঝামেলায় পড়বে, জেলে যাবে। ইজ ইট এ ফেয়ার?’
আক্ষেপ প্রকাশ করে আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘শিল্পমালিকরা এখন জিন্দা লাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব আশ্চার্য লাগে, দেশের অর্থনীতি কীভাবে টিকে থাকবে, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোরও খুব একটা মাথাব্যথা নেই। অর্থনীতি যদি ঠিক না থাকে, কর্মসংস্থান যদি না হয়, উত্পাদন ব্যাহত হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কীভাবে।’
বিটিটিএলএমইএ-এর চেয়ারম্যান হোসেন মেহমুদ বলেন, ‘গ্যাসের অভাবে ইতোমধ্যে ৫-৬টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ সমস্যা সমাধান করতে না পারলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এক্ষেত্রে গ্যাস রেশনিং করা যেতে পারে। অনেক বিতরণকারী কোম্পানির গ্যাস সারপ্লাস থাকছে। সেগুলো ঠিকমতো বিতরণ করতে পারলে শিল্প এত ভুগত না। ৭ বছর আগে শুনেছিলাম ভোলায় গ্যাস আছে, সেই গ্যাস ঢাকায় আনতে ৫ বছর সময় লাগবে। এখন ৭ বছর পার হলেও কাজই শুরু হয়নি।’
গ্যাস-বিদু্যতের সংকট হবে, তা এক বছর আগেই অনুমান ছিল মন্তব্য করে বিটিএমএ-এর পরিচালক রাজিব হায়দার বলেন, ‘গ্যাস-বিদূৎ না দিয়ে উৎপাদন বন্ধ রেখে, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও শ্রমিকদের বেতন দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে সাঁতার কাটার লেভেলটাও ক্রস করে ফেলছি।
গাড়ি-বাড়ি বিক্রি করে বেতন দেওয়ার কথা সরকার তো বলেছেই, আগামী দিনে হয়তো ব্যবসায়ীদের নিজেদেরই নিলামে তুলতে হবে।’ তিনি বলেন, Èসব দোষ কি শুধু ব্যবসায়ীদের। সরকার গ্যাস-বিদূৎ দিতে পারছে না, এটা কি তার দোষ নয়।’
রাজীব হায়দার বলেন, ‘গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এখন থেকে কূপ খননে নজর দেওয়া উচিত। তা না হলে ৫-৬ বছরের মধ্যে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। ভোলার গ্যাস ঢাকায় আনতে পাইপলাইন স্থাপন ও সমুদ্রে অফশোর গ্যাস কূপ খননে মনোযোগ দিতে হবে।
কয়লা উত্তোলনে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। কারণ, কয়লার জন্য রামপাল বিদূৎকেন্দ্র চলে না। অথচ কয়লা মাটির নিচে পড়ে আছে। পরিবেশের প্রভাব পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে দ্রুত সদ্ধিান্ত নিতে হবে।’
বিটিএমএ পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘সরকার কি টেক্সটাইল শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে চায়, নাকি পাট ও চিনিশিল্পের মতো অন্যদের হাতে দিয়ে দিতে চায়, তা বুঝতে পারছি না। গ্যাস না থাকলেও অদ্ভুত বিল করা হচ্ছে।’
বিটিএমএ পরিচালক সালেহউদ জামান বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে কারখানায় দিনের অধিকাংশ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। অথচ আমার ফ্যাক্টরিতে প্রতিদিন বেতন আসে ৬০ লাখ টাকা। শ্রমিকরা শুয়ে-বসে সময় কাটিয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছে।
৫-৬ মাস শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছি। তার ওপর ‘পালস মিসিং’-এর নামে গ্যাস কোম্পানিগুলো অনেক বিল নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিল্পমালিকরা আগামী দিনে কীভাবে টিকে থাকবে? যে অবস্থা চলছে, আগামী দিনে কেউ আর ব্যবসায়ী হতে চাইবে না।’
তিনি বলেন, ‘একাত্তর সালে বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে মারা হয়েছে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার জন্য। আর আজ গ্যাস-বিদ্যতের সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়ে শিল্পোদ্যোক্তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। গ্যাস-বিদূতের সংকট চলমান থাকলে এক-দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের অর্ধেক ফ্যাক্টরি শাটডাউন হয়ে যাবে।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- বিটিএমএর সহসভাপতি শামীম ইসলাম, পরিচালক সৈয়দ এনায়েত কবির, শাহিদ আলম প্রমুখ।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ