ব্যাপক সমালোচনা, প্রতিবাদের ঝড় এমনকি হত্যা মামলাও যাকে সরাতে পারেনি-তিনি হচ্ছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গতবছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও, দাপটের সাথে এক বছরেরও বেশি সময় সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের এই সচিব।
শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে যেসব সরকারি কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অন্যতম একজন ছিলেন এই নাজমুল আহসান। জুলাই গণঅভ্যূত্থানের আগ পর্যন্ত যার ফেইসবুক প্রোফাইলে “’WE ALL ARE SHEIK HASINA’S MEN’ লেখা স্টিকার যুক্ত ছিল। এমন একজন সচিবের বিরুদ্ধে কেন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নেয়নি? কেন পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তাকে নিয়েই এতটা পথ হাঁটলেন? এনিয়ে নানা মত থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে- সকল দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই তিনি তার কর্মজীবনের শেষ টানবেন আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এদিন তার শেষ অফিস। ১৭ আগষ্ট তিনি অবসরে যাচ্ছেন। তিনি ১৯৯৪ সালে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।
হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে দেশের বিভিন্ন জেলায় যৌথ বাহিনীর অভিযান চলতো। এসব অভিযানের মাধ্যমে বিরোধী দলের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালানো হতো। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালের দিকে সাতক্ষীরায় জামায়াত-বিএনপি নিধনে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালানো হয়। এতে মূল নেতৃত্ব দেন সাতক্ষীরা জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাজমুল আহসান ও পুলিশ সুপার(এসপি) চৌধুরি মঞ্জুরুল কবির। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চৌধুরি মঞ্জুরুল কবির দেশ ছেড়ে পালালেও এখনো অন্তর্বর্তী সরকারে সচিব হিসেবে দায়িত্বে পালন করছেন নাজমুল আহসান।
গত ২৬ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব ও সাতক্ষীরার সাবেক জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান, পুলিশ সুপার চৌধুরি মঞ্জুরুল কবিরসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলার বাদি সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা এলাকার মো. ওবায়দুল্যাহ। বাদি তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালে পহেলা জানুয়ারি তার বাড়ি ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে লুটপাট করে তৎকালীন সরকারের পেটুয়া বাহিনী। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ডিসি নাজমুল আহসান।
কেন তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠে?
নাজমুল আহসান সাতক্ষীরার ডিসি (জেলা প্রশাসক) পদে দায়িত্ব পালনকালে রাজনৈতিক সহিংসতা, খুন, গুম এবং অবৈধ নির্বাচনের সাথে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সাতক্ষীরায় তার মেয়াদে বিভিন্ন ভুক্তভোগী পরিবার এবং সচেতন নাগরিকের ব্যানারে একাধিক মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে, যেখানে তার বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত অভিযোগগুলো আনা হয়েছে:
অবৈধ নির্বাচন: তাকে অবৈধ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা: তার সময়ে সাতক্ষীরা জেলায় রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৩ জন নিহত হন, যার মধ্যে ২৭ জন যৌথবাহিনীর গুলিতে মারা যান। নিহতরা সবাই স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ছিলেন। এ ছাড়া আরও ২৫ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ এবং আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক ব্যক্তি।
বাড়ি ভাংচুর: ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি একটি বাড়িতে বুলডোজার দিয়ে ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে, যার নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়।
এসব কারণে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এবং বিভিন্ন সংগঠন সাতক্ষীরায় মানববন্ধন করে তাকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। এ বিষয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে।
‘বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’-এর আন্দোলন: বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম নামের একটি সংগঠনও নাজমুল আহসানসহ পাঁচজন সচিবকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছে। তাদের দাবি, এই সচিবরা পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ছিলেন এবং প্রশাসনে বৈষম্য সৃষ্টি করছেন। এই ফোরাম তাদের পদত্যাগের দাবিতে অফিস ঘেরাও করাসহ বিভিন্ন কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল।
নাজমুল আহসানকে সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে এই আন্দোলনগুলো বিভিন্ন সময় হয়েছে এবং এর ফলে বিষয়টি গণমাধ্যমেও আলোচনায় এসেছে। তবে, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।
এতো আন্দোলনের পরও কেন তাকে সরানো হয়নি?
নাজমুল আহসানকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বহাল রাখার কয়েকটি কারণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে:
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা: কিছু সূত্র অনুযায়ী, নাজমুল আহসানকে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের একজন “সুবিধাভোগী” কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ‘WE ALL ARE SHEIK HASINA’S MEN’ লেখা স্টিকার যুক্ত থাকার অভিযোগও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ক্ষমতা কাঠামোতে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাব রাখেন, যা তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও পদে বহাল থাকতে সাহায্য করেছে।
উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আশীর্বাদ: কিছু সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার “আশীর্বাদপুষ্ট” হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও সেই উপদেষ্টার নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে এই ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তিনি এখনো স্বপদে আছেন বলে মনে করা হয়।
তদন্ত প্রক্রিয়ার ধীরগতি: তার বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় হত্যা, গুম ও অবৈধ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে মামলা হয়েছে এবং গোয়েন্দা সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু করেছে। তবে এই তদন্তের ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসনিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হতে পারে।
প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ: জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রশাসন এখনো পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগী আমলাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই আমলারা সরকারের পরিবর্তনের পরেও তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব বজায় রেখেছে, যার ফলে নাজমুল আহসানের মতো কর্মকর্তাদের অপসারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
নাজমুল আহসানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
নাজমুল আহসানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও দূর্নীতি দমন কমিশন এসব খতিয়ে দেখছে।
পাওয়ার প্ল্যান্টের দুর্নীতি: একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের (পাওয়ার প্ল্যান্ট) জন্য বরাদ্দ করা নদীর জায়গা অবৈধভাবে ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ প্ল্যান্টটিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা নিয়ে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ে প্রভাব: বলা হয় যে, তিনি পূর্ববর্তী সরকারের সময় প্রভাবশালী ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ রয়েছে।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র: কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ বেশ প্রচলিত। এই দুর্নীতির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্ত করছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। অভিযোগ রয়েছে, নাজমুল আহসান বিদ্যুৎ বিভাগে দায়িত্ব পালনের সময় (যুগ্মসচিব ও উপসচিব হিসেবে) তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং সাবেক মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের সাথে মিলে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি