জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় শহীদ শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদের (মোস্তাকিম) মরদেহ বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি ও আসামিপক্ষের জেরায় এ কথা বলেন জুনায়েদের বাবা শেখ জামাল হাসান।
গণঅভ্যুত্থানের সময় চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ শেখ জামাল হাসানসহ দুজন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনজন সাক্ষী জবানবন্দি দিলেন।
জবানবন্দিতে শেখ জামাল হাসান জানান, ৫ আগস্ট সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ১৪ বছর বয়সী তার একমাত্র ছেলে জুনায়েদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে বের হয়। সেদিন বেলা ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে তার শ্যালক ফোন করে ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানান।
গুলিবিদ্ধ জুনায়েদকে তার বন্ধু সিয়ামসহ কয়েকজন মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায় বলেও উল্লেখ করেন শেখ জামাল হাসান।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, জুনায়েদকে মিটফোর্ডে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা বলেন- মরদেহ নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে মরদেহ হাসপাতালে রাখা যাবে না। তাড়াতাড়ি নিয়ে না গেলে মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে দিয়ে দেওয়া হবে। বুড়িগঙ্গায় মরদেহ ফেলে দেওয়ার কথাও বলেন চিকিৎসকেরা।
এসময় তিনি আরও বলেন, ‘১৪ বছর বয়সী সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো জীবনযাপন করছি আমি ও আমার স্ত্রী। আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনের হাফেজ ছিল। কী দোষ ছিল ওর। ছেলে হারানোর বেদনায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। ওরা আমাকে কেন গুলি করে মারল না।’
এসময় সাক্ষী হিসেবে ছেলে হত্যাকারীদের ফাঁসি চেয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ জুনায়েদের বাবা। এ মামলার তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি পেশ করেন।
জবানবন্দিতে শেখ জামাল বলেন, ‘আমি এখন অবসর জীবনযাপন করছি। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম জুনায়েদ। বয়স ১৪ বছর। মেয়েটা বড়। ছেলেটা সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। চব্বিশের জুলাইয়ের শুরু থেকেই পরিবারসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম আমি। আমার স্ত্রী-সন্তানরা অনেকটা সক্রিয় ছিলেন।’
তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক পৌনে ১১টায় জুনায়েদ তার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। আমরা তখন বাসায় ছিলাম। ওই সময় আমার স্ত্রী-মেয়েও বাসা থেকে বের হয়। তারা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে আমার ফোনে কল আসে।
কল ধরতেই আমার শ্যালক আসিফ বলেন- জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর আমি গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে ও আজগর আলী হাসপাতালে গিয়ে খুঁজতে থাকি। দুপুর ২টার দিকে মোবাইল ফোনে কল করে বাসায় যেতে বলেন আমার ভাতিজি। একইসঙ্গে বলা হয়, জুনায়েদের লাশ বাসায় এসেছে। পরে বাসায় গিয়ে দেখি আমার ভাই আব্দুর রহমানের ফ্ল্যাটে তার নিথর দেহ পড়ে আছে।
শেখ জামাল বলেন, আমি দেখলাম জুনায়েদের বাম চোখে গুলি লেগে মাথার পেছন দিকে বড় গর্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে। এছাড়া সেখানে ছেলের বন্ধু সিয়ামসহ আরও কয়েকজনকে দেখি। পরে তারা তার মৃত্যুর ঘটনা খুলে বলে।
এ সময় জুনায়েদের বন্ধু সিয়াম জানায়, শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের দিক থেকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। পরে তারা কয়েকজন ছাত্র মিলে রিকশায় করে আমার ছেলেকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তখন ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় হাসপাতালের ডাক্তারদের পীড়াপীড়িতে তারা দ্রুত আমার ছেলের মরদেহ বাসায় নিয়ে আসে। ডাক্তাররা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে মরদেহ হাসপাতালে রাখা যাবে না।
তাড়াতাড়ি না নিয়ে গেলে তারা বেওয়ারিশ মরদেহ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে দেবে বলে হুমকি দেয়। না হয় বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিবে এবং তাদের সঙ্গে ডাক্তাররা খারাপ ব্যবহার করে।
তিনি আরও বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্মকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা থানার এডিসি আক্তারুল ইসলাম, মো. ইমরুল, এরশাদের নির্দেশে ৪০ থেকে ৫০ জন পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি বর্ষণ করে।
এর মধ্যে টার্গেট করে আমার ছেলেসহ মিছিলে গুলি করেন কনস্টেবল সুজন ও নাসিরুল। পুলিশের গুলিতে শাহরিয়ার খান আনাস, ইয়াকুব, রাকিব, মানিকসহ আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
জবানবন্দিতে এই সাক্ষী আরও বলেন, ‘আমি শুনেছি সুজন আমার ছেলেকে গুলি করেছে। আমি যখন আমার ছেলেকে দেখতে পাই তখনও তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার ছেলেকে গুলি করার ভিডিও আমার কাছে আছে। আমি আসামিদের বিচার চাই। তাদের ফাঁসি চাই।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ