
ভারতের আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ নিয়ে চুক্তি প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে, এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। কিন্তু এটা যদি ভায়োলেট করা হয় তাহলে কিন্তু চুক্তি বাতিল করা যায়।
রোববার (২ নভেম্বর) সচিবালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংক্রান্ত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটি আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, চুক্তি বাতিলের একটা প্রক্রিয়া আছে৷ সাধারণ কোনো কারণ দেখিয়ে এবং কারণ ছাড়া দুইভাবে চুক্তি বাতিল করা যায়। তবে কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে নির্ধারিত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ‘ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সে’ অধ্যাপক (অর্থনীতি) মোশতাক হোসেন খান বলেন, যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো সার্বভৌম চুক্তি। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে, একটি কোম্পানির চুক্তি সই হয়েছে। সার্বভৌম চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত। যদি মনে হয় এখানে কোনো কারচুপি হয়েছে আপনি ইচ্ছামত এটাকে বাতিল করতে পারবেন না।
এটা বাতিল করলে আপনার ওপরে অনেক বড় জরিমানা আসবে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে। এজন্য আমাদের অনেক সময় লেগেছে জাতীয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা যে প্রক্রিয়াগুলো কি ছিল। সেখানে কোথায় ব্যতিক্রম হয়েছে। আমরা যে বিষয়গুলো পেয়েছি এর সব কিছু অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে নেই। কারণ কিছু কিছু জিনিস চলমান। সেজন্য আমরা সেগুলোকে প্রকাশ করিনি।
তিনি আরও বলেন, আপনারা আগামী মাস খানেকের মধ্যে আরও অনেক দুর্নীতির তথ্য পাবেন। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি, এই দুর্নীতি আমাদের রোধ করতেই হবে। এটাকে মেনে নেওয়া বা সহ্য করা সম্ভব নয়।
ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিদ্যুতের দাম আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে এই দুর্নীতির কারণে। সাবসিটিগুলো সরিয়ে দিলে এটা হতো ৪০ শতাংশ হয়ে যাবে। আমাদের হিসেবে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না এই বিদ্যুতের দামে। তাই আমাদের এটাকে শুধরাতেই হবে। এটা যাতে না হয় আমাদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান বলেন, আমাদের প্রতিবেদনে আছে কোথায় কোথায় ভুলগুলো করা হয়েছে। যেখানে ইন্টারভেনশন করা হয়েছে, ওপর থেকে হুকুম এসেছে। প্রশাসন দিয়ে সবসময় নির্দোষ ছিল তাও না, সেটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মাশুলটা দিচ্ছে সাধারণ ভোক্তা ক্রেতা করদাতারা। আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছে।
এই যে বিশাল অংকের ঋণ ও বেশি দামের বিদ্যুৎ এটা আমরা দেব। যারা এখান থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে তাদের বুঝাতে হবে আপনারা এটা থেকে পার পাবেন না। আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করছি, অ্যাকশন নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে এটা আর না হয়। এটা অনেক কঠিন কাজ। সবাইকে একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে, কারণ এটা তাড়াতাড়ি করার কাজ নয়। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হবে। আমরা সফল হবো না এজন্য আমাদের একটু দেরি হচ্ছে যোগ করেন তিনি৷
এ বিষয়ে দ্বিতীয় আরেকটি রিট পিটিশন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম রিট পিটিশন করেছিলেন শাহদীন মালিক। দ্বিতীয় রিট পিটিশনের বিষয়ে পত্রিকায় সেভাবে আসেনি। সেটা আসা উচিতও নয়। পত্রিকায় খবর এসেছে যে আদানে চুক্তির সঙ্গে অনেক দুর্নীতি ছিল।
এই দুর্নীতি সম্পর্কে কেন কিছু করা হচ্ছে না? আদালত একটা রুলিং দিয়েছে ৬০ দিনের মধ্যে দুদকসহ যাদের নাম রিট পিটিশনে আছে তাদের একটা তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে। আমরা সেই কাজেও সহায়তা করছি। আমাদের বিশ্বাস আপনারা মাস খানেকের মধ্যে এই দুর্নীতির শক্ত প্রমাণ পাবেন।
সেটা যখন হবে তখন আদানি এবং আদানের সঙ্গে আরও কয়েকটি বড় বড় কোম্পানি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া চালু করা হবে ইনশাআল্লাহ।
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ কেনার জন্য যে চুক্তিগুলো ছিল সেগুলো আমরা করেছি এবং এর পেছনে যে চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে, একটি চুক্তি করার ক্ষেত্রে যাদের মতামত নিতে হয় সেই নদীগুলো আমরা দেখেছি, প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে নয় বড় বড় কেসগুলোর ক্ষেত্রে।
২০০৮-০৯ থেকে ২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত অর্থ পরিষদের তথ্যপত্র আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সেগুলো আমরা রিপোর্টে বিশ্লেষণ করে দেখেছি এই ডেটা থেকে কি ধরনের অনিয়ম চোখে পড়ে।
তিনি বলেন, কত বছর ২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে, কিন্তু অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ১ গুণ। এটি কোনো টেকনিক্যাল ফ্যাক্ট দিয়ে এক্সপ্লেইন করা সম্ভব নয়।
আমরা ২০১১ সালে বিদ্যুতের জন্য ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছিলাম, যেটা ২০২৪-এ এসে বেড়ে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কাদের টাকা পরিশোধ করছে এর বিপরীতে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ পাচ্ছি সেই হিসাব মেলানো যায় না সেটাই আমাদের মূল ফাইন্ডিং। বিশেষ বিধান আইনে বারবার মেয়াদ বাড়ানো হলো, বারবার দায়মুক্তির পথ খুলে গেল।
এছাড়া আছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ। বিদ্যুৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং অন্যান্য মিলে ওখানেও একটা সমস্যা আছে। এটা একদম চোখে পড়ে।
বাংলা৭১নিউজ/এবি