অবৈধ বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ভারত থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তার বিনিময়ে টাস্কফোর্স ফর ইন্টাররোগেশন (টিএফআই) সেলে আটক এক বাংলাদেশিকে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয় তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। গুম কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
বুধবার (৪ জুন) প্রতিবেদনটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয় কমিশন। ৫ জুন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্টের পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেল (জেআই সি) থেকে অন্তত আরও ১ জন এবং টাস্কফোর্স ফর ইন্টাররোগেশন সেল (টিএফআই) থেকে অন্তত ৫ ব্যক্তি মুক্তি পেয়েছিলেন।
তাদের একজন সুব্রত বাইন-যিনি ইন্টারপোলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় ছিলেন। তিনি হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বহু গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত।
সুব্রত বাইনকে ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার ২৩ শীর্ষ অপরাধীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১২ সালে নেপালের একটি জেল থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে যান তিনি। পরে ভারত থেকে কয়েকবার গ্রেফতার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার সক্রিয় হন। ২০২২ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে তাকে একটি গোপন অবৈধ বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুব্রত বাইনের বিনিময়ে যে বাংলাদেশিকে পাঠানো হয়েছিল, তাকে কমিশন শনাক্ত করে। তিনি ভারতে গিয়ে একটি মামলায় কারাবরণ করেন এবং পরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ভারতীয় কেস ডকুমেন্ট থেকে তার উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হয় কমিশন।
একই সঙ্গে আরেক বন্দি সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ওই ব্যক্তিকে টিএফআই সেলে দেখেছেন এবং তার নাম জেনেছেন। এর সূত্র ধরেই গুম কমিশন নিশ্চিত হয়, তিনিই ছিলেন সুব্রত বাইনের বিনিময়ে পাঠানো ব্যক্তি।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে আর বলা হয়, সুব্রত বাইন দাবি করেছেন, তাকে ২০২২ সালের ২৭ রমজান বাংলাদেশে আনা হয়। এটি ভারতীয় কেস ডকুমেন্টের সঙ্গে মিলে যায়। বন্দিত্বকালীন তিনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন এবং বাইরে কোনো যোগাযোগের আশা ছেড়ে দেন। এমনকি টিএফআই-এর কর্মকর্তারাও তাকে এড়িয়ে চলতেন। অনলাইনে ছড়ানো গুজব সত্ত্বেও কমিশন এমন কোনো তথ্য পায়নি যে তিনি ওই সময়ে কোনো প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।
তবে মুক্তির পর তিনি আবার তার অপরাধ জগৎ পুনরায় গড়ে তোলেন, এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করেন এবং কমিশনের তথ্যানুযায় আবার হত্যার আদেশ দিতে থাকেন। মে ২০২৫-এর শেষদিকে তাকে আবার গ্রেফতার করার আগ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো তাকে ধরতে হিমশিম খাচ্ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি জোরালোভাবে দেখায় যে, এমন একজন আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত ব্যক্তিকে আটক রাখার আদেশ র্যাব থেকে একা আসতে পারে না-এটি অবশ্যই অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, সম্ভবত আরও ঊর্ধ্বতন স্তরের সিদ্ধান্ত ছিল। প্রশ্ন থেকে যায় কেন তাকে বছরের পর বছর গোপনভাবে আটক রাখা হলো, আইনি প্রক্রিয়ায় না এনে অথচ অনেক কম অপরাধে অন্যদের হত্যা করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, একসময় তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
যদি তাকে আদালতে হাজির করা হতো তাহলে হয়তো বিচারব্যবস্থা শুরু থেকেই তাকে আটক রাখতে পারত। কিন্তু তাকে আইনের বাইরে রাখা হয়েছিল, ফলে তার মুক্তি আইনি নিয়মে নিয়ন্ত্রিত বা চ্যালেঞ্জ করা যায়নি। এভাবে তার অপরাধজগৎ আবার গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়।
এই ঘটনা আরও দেখায় যে, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে গোপন বিনিময় কতটা খরচসাপেক্ষ ও অনির্দেশ্য ফল বয়ে আনে। ভারতীয় পক্ষ যে বাংলাদেশিকে নিয়েছিল, তাকে সম্ভবত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তি দেয়। ফলে তার গুরুত্বপূর্ণ বন্দী হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। অন্যদিকে বাংলাদেশেও যেহেতু সুব্রত বাইনকে অবৈধভাবে আনা হয়েছিল আইনি ব্যবস্থায় তাকে আটক রাখা যায়নি।
সবমিলিয়ে এমন গোপনতা, অবৈধতা ও অনানুষ্ঠানিক চালবাজি বাংলাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত না করে দুর্বল করেছে—এটাই এই ঘটনার মূল শিক্ষা। জাতীয় নিরাপত্তার নামে গুমের মতো প্রক্রিয়াগুলো বাস্তবে প্রায়ই সেই নিরাপত্তাকেই দুর্বল করে।
২০১২ সালে বেইন নেপালের এক কারাগার থেকে একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে যান। এরপর তিনি ভারতে একাধিকবার গ্রেফতার হন, যার মধ্যে কলকাতাও ছিল। তবে প্রতিবারই তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
২০২২ সালের এপ্রিলের শেষে একটি গোপন ও অবৈধ বন্দি বিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমঝোতায় বেইনকে র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ, র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং-এর মাধ্যমে, তাদের নিজ দেশের এক নাগরিককে ভারতের হাতে তুলে দেয়, যিনি তখন টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন।
কমিশন ওই বাংলাদেশি ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। তিনি ভারতে পৌঁছানোর পর তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয় এবং তিনি সেখানে কারাদণ্ড ভোগ করেন। পরে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি সরবরাহকৃত ভারতীয় মামলার নথির মাধ্যমে ভারতে তার অবস্থানের প্রমাণ দেন। টিএফআই সেলে তার বন্দিত্বের বিষয়টি আরেকজন সহবন্দি দ্বারা নিশ্চিত হয়, যিনি সেখানে তাকে দেখে তার নাম জেনেছিলেন। এই ঘটনা বিশ্লেষণের পরই জানা গেছে তিনিই বেইনের বিনিময়ে ভারতকে হস্তান্তর করা ব্যক্তি।
বেইন অভিযোগ করেন যে তাকে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল ২০২২ সালের রমজান মাসের ২৭ তারিখে। যে ভারতীয় মামলার নথি পর্যালোচনা করি, তা এই তারিখের সঙ্গে মিলে যায় এবং ঘটনাপ্রবাহের সময়রেখা নিশ্চিত করে। টিএফআই-তে থাকাকালে বেইন বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় ভোগেন, যার মধ্যে পাইলসও ছিল।
তিনি বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখার আশা ছেড়ে দেন। এমনকি টিএফআই-তে কর্মরত কর্মকর্তারাও তার সঙ্গে দেখা করতে এড়িয়ে যেতেন। অনলাইনে প্রচলিত গুজবের বিপরীতে কোনো তথ্য পাইনি যা নির্দেশ করে যে তিনি সেখানকার অবস্থানকালে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বরং তিনি নিঃসঙ্গ বন্দিত্বের জীবন অতিবাহিত করছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।
তবে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পুনরায় তার অপরাধ জগৎ পুনর্গঠন করেন একজন প্রভাবশালী অর্থবান পৃষ্ঠপোষক খুঁজে পান যিনি রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত এবং আমাদের জানা মতে তিনি আবারও হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিতে শুরু করেন। ২০২৫ সালের মে মাসের শেষে তার পুনঃগ্রেফতার পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাকে ধরতে হিমশিম খাচ্ছিল।
ঘটনাটি গভীর উদ্বেগের বিষয় এবং এটি জোরপূর্বক গুম প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক পরিণতি ও প্রভাবকে তুলে ধরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এত উচ্চ আন্তর্জাতিক কুখ্যাতিসম্পন্ন একজনকে আটক রাখার নির্দেশ শুধুমাত্র র্যাব থেকে আসতে পারে না। র্যাবের সাংগঠনিক সংস্কৃতি অনুযায়ী এটি অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পর্যায়, এমনকি তার চেয়েও উচ্চ পর্যায় থেকে আসা সিদ্ধান্ত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
তবুও এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে র্যাব ইন্টেলিজেন্স এতদিন ধরে সুব্রত বাইনকে বাইরের জগৎ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় গোপনে বন্দি করে রেখেছিল কেন, বিশেষ করে যখন তারা তুলনামূলকভাবে সামান্য অপরাধে অভিযুক্তদেরও নির্মূল করেছে। তাকে নিয়ে বিশেষ কিছু পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ