২০২১ সালের গ্রীষ্মেই যেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি জয়ের মঞ্চ প্রস্তুত করে ফেলেছিল প্যারিস সেইন্ট জার্মেই (পিএসজি)। ক্লাবটির দল সাজানো দেখে মনে হয়েছিল, এটি যেন ভিডিও গেম থেকে বানানো। একই সঙ্গে পিএসজির ড্রেসিংরুমে অবস্থান করছিলেন তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি, ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার ও আগে থেকেই দলে থাকা তরুণদের মধ্যে তৎকালীন সেরা তারকা কিলিয়ান এমবাপে।
এই তিন মহাতারকা নিয়ে আক্রমণভাগ সাজানো পিএসজি ফ্রান্সের ঘরোয়া লিগে নিয়মিত শিরোপা জিতলেও ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিযোগিতা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারেনি।
‘যত গর্জে তত বর্ষে না’- তিন তারকাকে দলে নিয়ে যেন বাংলা প্রবাদের বাস্তব রূপের অভিজ্ঞতাই হলো পিএসজির। ক্লাবটির ব্যর্থতা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে টানা দুই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে পিএসজিকে বিদায় নিতে হয়েছিল শেষ ষোলো থেকেই।
মাঠে সফল না হলেও ওই সময় আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছিল পিএসজি। ক্লাবটির দাবি, ওই সময় তারা ১ বিলিয়নের বেশি রাজস্ব অর্জন করেছিল।
শেষ পর্যন্ত তিনজনই ক্লাব ছেড়ে চলে যান। তাদের জায়গায় আসে কম খরচে ও কম পরিচিত কিছু তরুণ খেলোয়াড়কে দলে নেন পিএসজি কোচ লুইস এনরিক।
তিন মহাতারকা দল ছাড়ার পর বেশিরভাগ ক্লাবের ক্ষেত্রে এটি হতো কেবল পুনর্গঠনের শুরুর সময়। কিন্তু পিএসজি এমন কিছু অর্জন করে বসে, যা ক্লাবটিকে অনন্য করে তোলে। দুই বছরের ব্যবধানে অখ্যাত, কম ব্যয়ে গড়া পিএসজি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে সবাইকে অবাক করে দেয়। অতীতে যা তারকাবহুল দলগুলোও করতে পারেনি।
গতকাল শনিবার মিউনিখে ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে পিএসজি। এটা শুধু পিএসজির জন্য নয়, ফ্রান্সের ফুটবলের জন্যও ঐতিহাসিক। এখন পর্যন্ত একমাত্র ফরাসি ক্লাব হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল মার্সেই, সেটিও ৩২ বছর আগে।
এবার পিএসজি ফেবারিট ছিল। তবে এতটা সফল হবে, সেটি হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠাই ছিল একটি চমক। কিন্তু শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে যেভাবে ইন্টারকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে পিএসজি, সেটি দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারেননি ফুটবল ভক্তরা।
কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি করলো পিএসজি? সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ভক্তদের মনে।
২০২১ সালে এমবাপে ২২ বছর বয়সী হলেও দলের গড় বয়স ছিল প্রায় ২৮ বছর। যা গড় প্রতিপক্ষের তুলনায় দুই বছর বেশি। এবার তাদের গড় বয়স ২৫, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের চেয়ে দুই বছর কম।
২০২৩ মৌসুমের পর ক্লাবটি কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পেছনে দৌড়াবে না। বরং ধীরে ধীরে একঝাঁক তরুণকে নিয়ে প্রকল্প গড়ে তুলবে।
পরিকল্পনা অনুসারে, লুইস এনরিক ও স্পোর্টিং ডিরেক্টর লুইস ক্যাম্পোস তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের দলে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে ২০ বছর বয়সী ফরাসি উইঙ্গার দেজিয়ের দুয়ে, হুয়ান নেভেস ও উইলিয়ান পাচো অন্যতম। সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় হলেন ৩১ বছর বয়সী ডিফেন্ডার মারকুইনহোস।
এছাড়া দলে আছেন উসমান ডেম্বেলে (মূল স্কোরার), ২২ বছর বয়সী ব্রাডলি বারকোলা (যাকে ইউরোপের অন্যতম সেরা ড্রিবলার ও লিগ ওয়ানের সেরা পাসার বলে উল্লেখ করেন কোচ এনরিক) ও জানুয়ারিতে যোগ দেওয়া খভিচা কাভারেস্কাইয়া।
এদের সবাইকে একত্রে বুনে এনেছেন এনরিক। বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানো এবং স্পেন জাতীয় দলের সাবেক এই কোচের পিএসজিতে যোগ দেওয়ার সময় লক্ষ্য ছিল, এমন এক দল গঠন করা; যারা একসঙ্গে আক্রমণ ও রক্ষণ করতে পারবে।
এনরিকের কৌশল নিয়ে সাংবাদিক অ্যালিস লেফেভ্রে বলেন, ‘যতদিন এনরিক থাকবেন, ততদিন এই ক্লাব তারকানির্ভর নয় বরং তরুণদের নিয়ে কাজ করবেই।’
এনরিক শুধু কৌশলগত বদল আনেননি, মনোভাবেও পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বলেন, ‘পিএসজি খেলোয়াড়দের বুঝতে হবে, তুমি হয়তো শুরুই করতে পারবে না, এমনকি বদলি নাও হতে পারো। কিন্তু প্রস্তুত থাকতে হবে শতভাগ।’
স্পোর্টস বিশ্লেষক ও সাবেক প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলার রবি মাসটো বলেন, ‘তারকা খেলোয়াড় থাকা মানেই সফলতা নয়—পিএসজির অতীত সেটির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একটি দল হতে হলে সবাইকে কাজ করতে হয়, শুধু বল পেলে জ্বলে উঠলেই হবে না। এখন আর কোনো ‘‘প্যাসেঞ্জার’’ খেলোয়াড় চলে না।’
অবশেষে মিউনিখের অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনা থেকে এনরিকের দূরদর্শী চিন্তা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলে পিএসজি। গোল করেন এনরিকের হাতে গড়া আশরাফ হাকিমি, দেজিয়ের দুয়ে (জোড়া গোল), কাভারেস্কাইয়া ও সেনি মায়লুলু।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ