তরুণ ছাত্র যুবকদের (জেন জ়ি) বিদ্রোহের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে নেপাল সরকার। সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হয়েছে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির প্রশাসনকে। তরুণদের বিক্ষোভে সোমবার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে।
হাজার হাজার তরুণ ছাত্র যুবক নেপালের পার্লামেন্টের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেক স্কুলপড়ুয়াও ছিল। অন্তত পোশাক দেখে তেমনই অনুমান। শুধু রাজধানী শহরেই নয়, বিক্ষোভ-বিদ্রোহের আঁচ ছড়িয়েছিল নেপালের অন্যত্রও। সোমবারের ওই বিক্ষোভে অন্তত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে শুধু সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞাই নয়, সোমবারের বিক্ষোভের নেপথ্যে থাকতে পারে আরও অনেক চাপা অসন্তোষ।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে নেপাল সরকার। তাদের বক্তব্য, সাইবার অপরাধ, ভুয়ো এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর উপর রাশ টানার জন্যই এই পদক্ষেপ। নেপালের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে গত মাসেই নেপাল সরকার বিভিন্ন সমাজমাধ্যম সংস্থার নিবন্ধীকরণ (রেজিস্ট্রেশন)-এর জন্য উদ্যোগী হয়। কোনও অভিযোগ জানানোর জন্য কোনও সংস্থার আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সে বিষয়েও তথ্য চাওয়া হয়। এর জন্য গত ২৮ অগস্ট থেকে এক সপ্তাহের সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলিকে। এর মধ্যে যে সমাজমাধ্যমগুলি নেপাল সরকারের সঙ্গে নিবন্ধীকৃত হয়নি, সেগুলিকে গত সপ্তাহে নিষিদ্ধ করে দেয় সে দেশের প্রশাসন।
নেপাল সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সে দেশে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াট্সঅ্যাপ, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউব-সহ ২৬টি সমাজমাধ্যম নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যদিও রয়টার্স জানাচ্ছে, যে সংস্থাগুলি নিবন্ধীকরণ সেরে নিয়েছে, সেগুলির উপর কোপ পড়েনি। এই তালিকায় রয়েছে টিকটক, ভাইবার, উইটক, নিমবাজ় এবং পপ্পো লাইভ।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী গত রবিবার বলেছিলেন, তাঁর প্রশাসন সমাজমাধ্যমের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু যে সমাজমাধ্যমগুলি নেপালে ব্যবসা করছে, তারা সে দেশের আইন মেনে চলছে না। এটি মেনে নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছিলেন ওলি। সঙ্গে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, সরকারের নির্দেশ মেনে চললেই এই সমাজমাধ্যমগুলি পুনরায় চালু হয়ে যাবে।
তবে সরকারের এই পদক্ষেপ নেপালে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আসলে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ। নেপালের অর্থনীতি অনেকাংশেই পর্যটনের উপর নির্ভরশীল।
পর্যটকের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা তাঁদের পেশাগত কাজের জন্য সমাজমাধ্যমেই যোগাযোগ করে থাকেন। পাশাপাশি প্রবাসীদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগেরও অন্যতম মাধ্যম এই সমাজমাধ্যমগুলি। ফলে সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র তরুণ প্রজন্মকেই নয়, সকলকেই সমস্যায় ফেলেছিল।
সোমবার যে বিক্ষোভ হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞাকেই তার কারণ বলে মনে হলেও, এটিই এক মাত্র কারণ নয়। অনেকের মতে, সোমবার যা ঘটেছে, তা দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা তাতে অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র। ২০০৮ সাল থেকে নেপাল একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। তার পর থেকে নেপালের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। তাঁদের অনেকে ক্ষমতায় এসেছেন, আবার সরে গিয়েছেন।
দুর্নীতিতে নাম জড়ানো ওই নেতাদের বেশির ভাগই ষাটোর্ধ্ব। তবে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক জন তরুণ নেতা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন নেপালে। তাঁদের জনপ্রিয়তার নেপথ্যে অন্যতম অবদান ছিল সমাজমাধ্যমের। নেপাল সরকারের এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিলেন ওই তরুণ নেতারাও। যেমন কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহ একজন র্যাপ সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ‘জেন জ়ি’-র বিদ্রোহকে প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়েছেন।
সোমবার ওই বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করেছিল ‘হামি নেপাল’ নামে একটি সংগঠন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট অনুসারে, ওই সংগঠনের চেয়ারপার্সন সুধন গুরুংয়ের দাবি, এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সরকারি পদক্ষেপ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। বস্তুত, নেপালি তরুণদের মধ্যে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ অনেক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব, জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যা। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থাপনা নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। এর ফলে নেপালি তরুণদের অনেকেই দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ ছাড়া নেপালে দীর্ঘ দিন ধরে নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠাও এই বিদ্রোহের একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। নেপালের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে অতীতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অতীতে তিন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর (মাধব নেপাল, বাবুরাম ভট্টরাই এবং খিলরাজ রেগমি) বিরুদ্ধে সরকারি জমি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল।এই সব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষোভ জমছিল।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র:আনন্দবাজার অনলাইন