বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৪:২৩ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ

রাতারাতি ‘লাল নদী’র ৩০০ বাঁধ ভেঙে ফেলল চীন, দিল্লীর চিন্তা

বাংলা 71 নিউজ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫
  • ২১ বার পড়া হয়েছে

একটা-দু’টো নয়, একসঙ্গে ৩০০ বাঁধ ভেঙে ফেলল চিন। রাতারাতি তালা পড়ল একগুচ্ছ ছোট পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। কেন হঠাৎ নিজেদের তৈরি বাঁধ পর পর ধ্বংস করছে বেজিং? সম্প্রতি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে হংকঙের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর নেপথ্যে রয়েছে দু’টি কারণ। এক, মাছের জোগান বজায় রাখা। আর দুই নদীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার।

চিনের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলির অন্যতম হল ইয়াংৎজ়ি। তিব্বতের টাংগুলা পর্বতমালা থেকে উৎপত্তি হয়ে ওই জলধারা পূর্ব চিন সাগরে গিয়ে পড়েছে। ইয়াংৎজ়ি ইউরেশিয়ার দীর্ঘতম নদী হিসাবে পরিচিত। লম্বায় এটি প্রায় ৩৯৬১ মাইল (পড়ুন ৬,৩৭৪ কিলোমিটার)। ড্রাগনভূমির এক পঞ্চমাংশ জমি সংশ্লিষ্ট নদীটির অববাহিকায় গড়ে উঠেছে। এ-হেন ইয়াংৎজ়ির প্রধান উপনদী চিশুই হে-র উপর থাকা যাবতীয় বাঁধ বেজিং ভেঙে ফেলেছে বলে জানিয়েছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

চিনে আবার ইয়াংৎজ়ির উপনদী চিশুই হে-র আলাদা পরিচিতি রয়েছে। পানির রং রক্তের মতো হওয়ায় মান্দারিনভাষীরা এর নাম রেখেছেন ‘লাল নদী’ বা রেড রিভার। ড্রাগনভূমির ইউনান, গুইঝো এবং সিচুয়ান প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইয়াংৎজ়িতে গিয়ে মিশেছে চিশুই। সংশ্লিষ্ট নদীটির উপরে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৩৫৭টি বাঁধ তৈরি করেছিল বেজিঙের শি জিনপিং সরকার।

চলতি মাসে স্থানীয় গণমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে চিশুইকে নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে হংকঙের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট। সেখানে বলা হয়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নদীটির উপরে থাকা ৩০০টি বাঁধ ভেঙে ফেলে চিনা প্রশাসন। ফলে এখন ইয়াংৎজ়ির উপনদীটির উপর টিঁকে আছে মাত্র ৫৭টি বাঁধ। বেজিঙের এই সিদ্ধান্তের ফলে ওই এলাকার ৩৭৩টি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে বন্ধ হয়েছে ৩৪২টি।

শি প্রশাসনের পর পর বাঁধ ভেঙে ফেলার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হল ‘লাল নদী’র মাছ। পরিবেশবিদদের দাবি, চিনে দিন দিন বিরল হয়ে পড়ছে ওই জলজ প্রাণী। ভবিষ্যতে এর মারাত্মক প্রভাব দেখা যেতে পারে ইয়াংৎজ়ির বাস্তুতন্ত্রে। চিশুই নদী মাছের শেষ নিরাপদ স্থান বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা। সেই কারণে বিপুল আর্থিক লোকসান মেনেও ৩০০টি বাঁধ ধ্বংস করতে বাধ্য হয়েছে বেজিং।

পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন, ইয়াংৎজ়ির উপনদীর উপরে বাঁধ ও পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জেরে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে জলের স্বাভাবিক প্রবাহ। এর জেরে হ্রাস পাচ্ছে স্থানীয় নদীতে মাছের প্রজনন। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ঝৌ জ়িয়ানজ়ুন। এর ক্ষতিকর প্রভাবটি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের কাছে ব্যাখ্যা করেন তিনি।

অধ্যাপক জ়িয়ানজ়ুন জানিয়েছেন, নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছোট পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা। ওই সময়ে পরিবেশগত বিপদ বা নদীর বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির কথা ভাবা হয়নি। ফলে সময়ের চাকা ঘুরতেই স্থানীয় মাছগুলি বিরল জলজ প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশগত চাহিদা মেটাতে বাঁধ ভাঙার পরেও জল নিয়ন্ত্রণের উপরে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

ইয়াংৎজ়ি এবং তার উপনদীগুলিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্টার্জন মাছের বাস। পরিবেশবিদরা একে সংশ্লিষ্ট স্রোতস্বিনীগুলির ‘শেষ দৈত্য’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। ২০২২ সালে ‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন’ (পড়ুন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ান ফর কনজ়ারভেশন অফ নেচার) সংশ্লিষ্ট মাছটিকে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী বলে ঘোষণা করে। এর পরেই টনক নড়ে চিনা সরকারের। শুরু হয় মাছগুলিকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া।

স্টার্জনের বংশরক্ষায় ২০২২ সাল থেকে ধীরে ধীরে চিশুই নদীর উপর থেকে এক এক করে বাঁধ ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করে বেজিং। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ‘লাল নদী’তে এক ঝাঁক স্টার্জন মাছ ছেড়ে দেন ‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এর ‘ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোবায়োলজি’র গবেষকেরা। সংশ্লিষ্ট জলজ প্রাণীগুলি নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পেরেছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।

চলতি বছরের এপ্রিলে গুইঝো প্রদেশে ‘লাল নদী’তে ২০টি প্রাপ্তবয়স্ক স্টার্জন মাছ ছাড়েন বেজিঙের গবেষকেরা। ‘ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোবায়োলজি’র সদস্য লিউ ফেই বলেছেন, ‘‘এটা ওদের প্রজননের আদর্শ সময়। এখনই ডিম ফুটে পোনা মাছগুলো বেরিয়ে আসে। চিশুই নদীর সঙ্গে স্টার্জন মাছগুলি এত সুন্দর ভাবে মানিয়ে নেবে, তা প্রথমে ভাবিনি। এখন মনে হচ্ছে ইয়াংৎজ়ির বদলে ‘লাল নদী’ই হয়ে উঠবে ওদের নতুন বাড়ি।’’

চিনা গবেষণা সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে স্টার্জন মাছের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় ২০২০ সালে ইয়াংৎজ়ি নদীতে ১০ বছরের জন্য মাছ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বেজিং। ২০২১ সালের শেষে সিচুয়ান প্রদেশে ৫,১৩১টি ছোট পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু পরিবেশের কথা ভেবে ১,২০০টি প্রকল্প বন্ধ করে দেয় জিনপিং প্রশাসন।

গত বছরের অগস্টে নদীর স্বাস্থ্য এবং জলজ জীববৈচিত্র্যের উপর একটি সরকারি রিপোর্ট প্রকাশ করে বেজিং। সেখানে বলা হয়, মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করায় নদীর বাস্তুতন্ত্রে বদল লক্ষ করা গিয়েছে। মাছ, উভচর এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর সংখ্যা চমৎকার ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান দেয়নি ড্রাগন প্রশাসন।

নদীর বাস্তুতন্ত্র ঠিক রাখতে গত বছর থেকে ইয়াংৎজ়ি অববাহিকার বিভিন্ন জায়গায় বালি তোলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে শি সরকার। পরিবেশ ধ্বংসের হাত থেকে জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত বলে জানা গিয়েছে। সাধারণ ভাবে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ক্ষেত্রে চিনকে সে ভাবে কখনওই পরিবেশের পরোয়া করতে দেখা যায়নি। সেই কারণেই ড্রাগনের এই সিদ্ধান্তে রীতিমতো হতবাক পশ্চিমি দুনিয়া।

ঘরের মাটিতে পরিবেশ রক্ষায় ৩০০ বাঁধ ভেঙে ফেললেও ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানতে রাজি নয় চিন। বর্তমানে তিব্বত থেকে অরুণাচল প্রদেশে বয়ে আসা ওই নদীর উপরে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ বানাচ্ছে বেজিং। বিষয়টি ভারতের সুরক্ষার ক্ষেত্রে ‘গুরুতর উদ্বেগের’ বলে অভিযোগ করলেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা পেমা খান্ডু। সংশ্লিষ্ট বাঁধটিকে ‘পানি-বোমা’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদী অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নামে পরিচিত। সিয়াং আরও নীচে নেমে এসে অসমে নাম নিয়েছে ব্রহ্মপুত্র। ভারতের আপত্তি উড়িয়ে ২০১৫ সাল থেকেই দফায় দফায় ওই নদীতে বাঁধ তৈরির কাজ চালাচ্ছে ড্রাগন সরকার। ফলে ক্রমশই জলস্তর কমেছে। চিনা বাঁধের কারণে অদূর ভবিষ্যতে অসম, অরুণাচল-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে জলসঙ্কট দেখা দিতে পারে মনে করছেন পরিবেশবিদদের একাংশ।

চিন আন্তর্জাতিক জলচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। ফলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য নয়। কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত একদলীয় বেজিঙের সরকারের দাবি, ব্রহ্মপুত্র্রের বাঁধটি তৈরি করতে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার (প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা) খরচের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বিশ্বের আর কোনও প্রকল্পে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়নি। ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন উপত্যকায় ভারত সীমান্তের অনতিদূরে বাঁধটি তৈরি করছে ড্রাগন।

অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী খান্ডুর আশঙ্কা, ভরা বর্ষার মরসুমে চিন পরিকল্পিত ভাবে ওই বিশাল বাঁধের ‘লক গেট’ খুলে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিপুল পানিরাশি হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে নেমে এলে উত্তর-পূর্বের রাজ্যটির টুটিং, ইংকিয়ং এবং পাসিঘাটের মতো শহরগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর তাই ওই বাঁধ নির্মাণকে ‘ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের নামান্তর’ বলে উল্লেখ করেছেন খান্ডু।

চিনের এই প্রকল্প চিন্তায় রাখছে নয়াদিল্লিকে। কারণ এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বেজিং। আর তার ফলে বিপাকে পড়তে পারে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশ। চিনের বাঁধ ব্রহ্মপুত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকে রুখে দিয়ে বর্ষায় উজানের দিকে আরও জল ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা। আবার শুখা মরসুমে জলের অভাবও দেখা যেতে পারে ভারত ও বাংলাদেশে।

বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2018-2025
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com