রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় চাঁদা না দেওয়ায় গত ৯ জুলাই সোহাগ নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও পাথর মেরে হত্যা করেন যুবদল ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মী। ওই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।
এসব বিক্ষোভে সাধারণ জনতা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুবদল, ছাত্রদলসহ বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোতে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। এমনকি বিএনপির এক নেতাও ফেসবুকে পোস্ট করে দল না করার ঘোষণা দিয়েছেন।
শনিবার (১২ জুলাই) সকালে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সারাদেশে শুধুমাত্র ছাত্রদলের ১৫ জনের পদত্যাগের তথ্য মিলেছে। এছাড়া ‘ইতিবাচক রাজনীতি করতে এবং দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় বিএনপি ব্যর্থ’- এমন অভিযোগ এনে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলেরও বেশকিছু নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শাদমান নাজিব পদত্যাগ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার পক্ষে এই মানসিক অবস্থা আর এই পরিস্থিতিতে রাজনীতি করা সম্ভব না। আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আমি ভবিষ্যতে কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবো না।’
তিনি আরও লেখেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সুস্থ রাজনীতি অসম্ভব। রাজনীতি হয়ে গেছে আয়ের উৎস। বিপ্লবে যার জন্য গুলি খাওয়া লাগে, রাজনীতিতে সেই গুলি করে। সব দলের প্রায় সব নেতারই দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস না থাকার পরও সবাই অভিজাত জীবনযাপন করেন।
এটা দেখে এখন ঘরে ঘরে নেতা ও দল তৈরি হচ্ছে। এত মাত্রাতিরিক্ত রাজনীতিকরণ মনে হয় বিশ্বে কোথাও নেই। রাজনৈতিক সংস্কারই পারে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে। কিন্তু এই ঘটনার পর আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি, যে আশায় ছিলাম তার কিছুই হলো না। তাই আমার পক্ষে এই মানসিক অবস্থা নিয়ে রাজনীতি করা অসম্ভব।’
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক লিসানুল আলম লিসান পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘বিশেষ করে ৫ আগস্ট পরবর্তীতে অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম, দেশ নতুন করে বিনির্মাণ হবে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, ৫ আগস্ট পরবর্তীতে দেশটাকে সুন্দরভাবে বিনির্মাণের পরিবর্তে সবাই যে যার মতো করে নিজের স্বার্থ এবং ভোগের রাজনীতি করে গেছে।
এই দায়ে জামায়াত, বিএনপি, এনসিপি সবাই দণ্ডিত। সবাই নয়া বন্দবস্তের কথা বললেও কেউ কথা রাখেনি। জুলাইকে কেউ স্মরণ করেনি। জুলাইকে কেউ মনে রাখেনি। শহীদদের রক্তের সঙ্গে সবাই নির্বিচারে গাদ্দারি করেছে।’
বিএনপির মালয়েশিয়া কমিটির সাবেক সহ-সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ড. ফয়জুল হক দলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সব কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সূর্যসেন হল ছাত্রদলের কর্মী মোহাম্মদ আবু সাঈদ। এ ছাড়াও পদত্যাগ করেছেন পিরোজপুর জেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি মো. রাকিব হাওলাদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য পারভেজ রানা প্রান্ত, মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার শ্যামসিদ্ধি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. আকাশ, তারাগঞ্জ উপজেলা শাখা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাজিম ইসলাম, মৌলভীবাজার জেলা শাখা ছাত্রদলের সদস্য রাব্বি, তাজপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন, রাণীগাও ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক মো. রায়হান, একই শাখার সহ-সভাপতি আরিফুল ইসলাম ইমরুল।
এছাড়াও পদত্যাগ করেছেন- গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজের দুই ছাত্রদল নেতা, বরিশালের দপদপিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মো. সৈকত, বগুড়ার ধুনট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সদস্য জিয়াউল হক, ঝাউডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক ইকরামুল কবির, পাবিপ্রবি ছাত্রদলকর্মী ইমরান, ভোলার দৌলতখান উপজেলা ছাত্রদলের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সৈকতসহ আরও অনেকে।
নেতাকর্মীদের এই পদত্যাগের ঘোষণা সবগুলোই ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে দেওয়ায় এসবের পুরোপুরি সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি। পদত্যাগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, গতকাল একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, আমরা সেটি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। পদত্যাগের বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু অফিসিয়ালি তারা আমাদের কিছু জানাননি। আমরা সবগুলো বিষয় পর্যালোচনা করছি।
তবে পদত্যাগের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বির আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, কিছু মানুষ বিবেকবান আছে, সবাই তো অন্ধ না। এটা একটা ভালো দিক। আমাদের দেশে এখন অন্ধভাবে রাজনীতি করার দিন না। এটা আমাদের জন্যে ভালো বিষয়। আমি তাদের খুবই অ্যাপ্রিশিয়েট করি, তারা যে তাদের মধ্যে এই উপলব্ধিটা আনতে পেরেছে এটা ইতিবাচক।
বাংলা৭১নিউজ/এবি