ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানে দালালদের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ঢাকার উত্তরা ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের ৩৫ জেলায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ অফিসে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানকালে প্রায় সব বিআরটিএ অফিসে দালাল চক্রের সরব উপস্থিতি পেয়েছে। সেবা পেতে ছদ্মবেশে প্রমাণ মিলেছে ঘুষ লেনদেনেরও।
বুধবার (৭ মে) দুদকের ঢাকাসহ তাদের জেলা কার্যালয় থেকে একযোগে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট থেকে সারা দেশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ৩৫টি জেলা কার্যালয়ে একযোগে অভিযান পরিচালিত হয়।
অভিযান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিটি এনফোর্সমেন্ট টিম কমিশনের নিকট পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং কমিশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যেসব অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে –
যশোর বিআরটিএ অফিস :
যশোর বিআরটিএ অফিসে অভিযানকালে তিনজন দালাল হাতেনাতে আটক করা হয়। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিচালিত মোবাইল কোর্টে দুইজন দালালকে ১ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড এবং অন্য একজনকে একই পরিমাণ অর্থদণ্ডসহ ৩ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
শেরপুর বিআরটিএ অফিস
শেরপুরের বিআরটি অফিসে ছদ্মবেশে সেবাগ্রহীতা সেজে অভিযান চালানো হলে অফিসের কিছু স্টাফের সঙ্গে দালাল ও অফিসসংলগ্ন কম্পিউটার দোকানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। আগত সেবাপ্রার্থীরা জানান, কিছু স্টাফের সহায়তায় দালালরা টাকা নিয়ে লাইসেন্স তৈরি করে দেন, না দিলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয়।
নীলফামারী বিআরটিএ অফিস :
এ অফিসে অভিযানকালেও ২ জন দালাল হাতেনাতে আটক হন। এ সময়ে সঙ্গে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তাদের অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বরিশাল বিআরটিএ অফিস
বরিশালে ছদ্মবেশী অভিযানকালে এক দালাল প্রতিটি ক্যাটাগরি-২ লাইসেন্সে ১০ হাজার ৫০০ টাকা করে মোট ২১ হাজার টাকা দাবি করেন। যেখানে সরকারি ফি মাত্র ৩ হাজার ৫২২ টাকা (লার্নার কার্ডসহ)। কথোপকথনের অডিও-ভিডিও রেকর্ড করে, দালালকে হাতেনাতে ধরা হয় এবং পরে তাকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
বাগেরহাট বিআরটিএ অফিস
এই অফিসে অভিযানকালে আউটসোর্সিং কর্মীদের মোবাইল ফোনে অস্বাভাবিক লেনদেন ও টাকা আদান-প্রদানের বার্তা পাওয়া যায়। পরীক্ষা খাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেকে ফেল করলেও অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে পাস করানোর প্রমাণ পেয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।
টাঙ্গাইল বিআরটিএ অফিস :
টাঙ্গাইলের বিআরটিএ অফিসে অভিযানকালে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় টিম এক ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে মোটরযান পরিদর্শক পরিচয় দিলেও বাস্তবে তিনি অফিসের কেউ নন। টিম মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেয়, ওই ব্যক্তি কীভাবে হেল্প ডেস্কে বসেছেন, তা যাচাই করার জন্য দায়িত্বে প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
গোপালগঞ্জ বিআরটিএ অফিস :
এ অফিসে অভিযানকালে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ ইস্যুতে ঘুষ লেনদেন, রেজিস্টার খাতায় সিরিয়াল নম্বর ফাঁকা রেখে দুর্নীতির সুযোগ রাখা, দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থেকে কর্মকর্তাদের অনিয়মে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। একজন আবেদনকারীর তাৎক্ষণিক অভিযোগের পর মাত্র ৫ মিনিটে তার কাজ নিষ্পত্তি করা হয়, যা অনিয়মের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। একজন সহকারী পরিচালক সপ্তাহে একদিন অফিস করার প্রমাণ পেয়েছে টিম।
ঠাকুরগাঁও বিআরটিএ অফিস
ঠাকুরগাঁও বিআরটিএ অফিসে অভিযানকালে দালালদের দৌরাত্ম্য ও অনিয়ম স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ২ জন দালালের মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়। ব্যবহারিক পরীক্ষায় ৩০০ টাকা করে আদায় এবং পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে কিছু ব্যক্তিকে পাশ করানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। দুইজন বহিরাগত ব্যক্তি কর্মচারী পরিচয়ে অফিসের বাইরে প্রভাব বিস্তার করছিলেন; তাদের পরিচয় ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ আইনি পদক্ষেপের জন্য বিআরটিএকে জানায় দুদকের টিম।
দিনাজপুর বিআরটিএ অফিস
এ অফিসে অভিযানকালে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। ২ জন দালালকে ৪ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়, আর বাকি ২ জনকে সতর্ক করা হয়।
এ ছাড়াও বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজবাড়ী, মৌলভীবাজার, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর, মাদারীপুর, নেত্রকোণা, নোয়াখালী, জয়পুরহাট, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, রাঙ্গামাটিসহ অন্যান্য বিআরটিএ অফিসে প্রায় একই রকম অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে দুদকের ইনফোর্সমেন্ট টিম।
এর আগে গত ২৯ এপ্রিল বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে প্রধান কার্যালয়সহ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ৩৬ অফিসে এবং গত ১৬ এপ্রিল দলিল রেজিস্ট্রেশন, তল্লাশি ও নকল উত্তোলনসহ অন্যান্য কাজে সেবা প্রার্থীদের হয়রানি এবং ঘুষ দাবিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে দেশের ৩৫ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অভিযান পরিচালনা করেছিল দুদক।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ