মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৪০ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ

যেভাবে সূচিত হয় আন্দোলনের আগুন

বাংলা৭১নিউজ ঢাকা:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫
  • ৯ বার পড়া হয়েছে

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের দ্রোহের অনুপ্রেরণা জোগানো উক্তি ‘আসছে ফাগুন, আমরা হবো দ্বিগুণ’— ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সেই ফাগুন আসার আগেই বহুগুণ হয়ে ফিরে আসে। প্রেক্ষাপট ছিল একই— ‘বৈষম্য’।

আন্দোলনের সূচনা

১ জুলাই ২০২৪, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে ঢাবি শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে অবস্থান নেন। ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগানে মুখরিত করে তারা মিছিল বের করেন এবং সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সমাবেশ করেন।

সমাবেশে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ২ জুলাই থেকে তিন দিনের কর্মসূচি এবং ৪ জুলাই পর্যন্ত সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেদিনই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরও একটি অধ্যায়।

আগুনের বিস্তার

৪ জুলাই পর্যন্ত একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। তারা কোটা সংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল এবং সেটিকে আইনে পরিণত করার দাবি জানান। পাশাপাশি শুধু প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণি নয়, সব গ্রেডে কোটা বাতিলের দাবি তোলেন। ৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেন।

এরই মধ্যে আন্দোলনের আগুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছড়িয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, বাংলাদেশ কৃষি, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি সফল করেন।

৭ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভকে ‘অযৌক্তিক’ মন্তব্য করে বলেন, বিষয়টি ‘সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত’। এই মন্তব্যের ফলে অবরোধ ও বিক্ষোভ আরও জোরালো হতে থাকে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো অবরোধের কারণে অন্যান্য জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

চূড়ান্ত মোড়

আন্দোলন চূড়ান্ত মোড় নেয় ১৪ জুলাই। সেদিন সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে গণপদযাত্রা করে আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন। একই দিনে সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’ এই মন্তব্যের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে।

হলে হলে ধ্বনিত হতে থাকে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান। তবে, ঢাবি ছাত্রদলের একদল কর্মী সেদিন রাতেই স্লোগান ধরেন— ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এই স্লোগানের জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেন।

ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা হামলা চালায়। আহত বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরেও।

১৬ জুলাই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হন। সরকার দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়। ওই দিন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ, যার ভিডিও দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে তীব্র ক্ষোভ জন্ম নেয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হলগুলো ছাত্রলীগের দখলমুক্ত করেন।

অসহযোগ আন্দোলন

১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে আগের দিন নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও গায়েবানা জানাজায় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা হাসপাতাল ও জরুরি সেবা খাত ব্যতীত সবকিছু বন্ধ রেখে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

প্রাণহানির মিছিল শুরু হয় ১৮ জুলাই, চূড়ান্ত বীজ বপন হয় আরও একটি গণঅভ্যুত্থানের। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। বিকেল থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নয় দফা দাবি ঘোষণা, দেশব্যাপী কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েন, আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরতে এলাকায় এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা— সবই ঘটে ১৮ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত। এর মধ্যেও থেমে থাকেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মিছিল।

পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিচয় দিতে ভয় পেতে শুরু করেন। বিশেষ করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ পরিচয় দেওয়াটা চরম ভীতির জন্ম দেয়। এভাবেই চলতে থাকে আন্দোলন।

১ আগস্টের পর থেকে জোরালো হতে থাকে অসহযোগ আন্দোলনের দাবি। তবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেননি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। ঘোষণাটি আসে ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। সেদিন রাজধানী ঢাকার লাখো মানুষ জড়ো হন শহীদ মিনারে।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ তখনও থেমে নেই। এমন পরিস্থিতিতে সমন্বয়কেরা প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা দেন। কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা আসে ‘৬ আগস্ট নয়, ৫ আগস্টেই মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি’ পালন করা হবে।

গণঅভ্যুত্থান ও বিজয়

৫ আগস্ট, সকাল থেকেই রাজধানীর সর্বত্র থমথমে পরিবেশ। বেলা ১১টার দিকে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসেন এবং সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ভারতে পালিয়ে যান। বিক্ষুব্ধ জনতা ও শিক্ষার্থীরা গণভবন ও সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবেশ করেন। অর্জিত হয় নতুন স্বাধীনতা, জন্ম নেয় স্বৈরাচারমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশের।

আন্দোলনকারীদের বক্তব্য

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মো. মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাজপথে আন্দোলন সমন্বয় করে আসছিল ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের ভাইয়েরা যখন পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন তখন আর আন্দোলন কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। গণঅভ্যুত্থানের বীজ তখনই বপন হয়ে গেছে মানুষের মনে। এরপরই আন্দোলন ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার পতনের দিকে নিয়ে যায়।

২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সফল করতে যা যা করা প্রয়োজন ছিল, তা-ই করেছে ছাত্রশিবির— বলেন মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ।

গণঅভ্যুত্থানে সামনের সারির যোদ্ধা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিটি গণআন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। তেমনি ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয় এখান থেকেই এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে তা শেষ হয়।

তিনি আরও বলেন, জুলাই আন্দোলন চলার একপর্যায়ে অর্থাৎ ১৭ তারিখ ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলেও আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ঢাকায় অবস্থান নেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে আন্দোলনটাকে সংঘটিত করা হয় এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। যেসব শিক্ষার্থী ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন তারাও তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলন সংঘটিত করেন। এটি ছিল সম্মিলিত আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব বিজয়।

বাংলা৭১নিউজ/এবি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2018-2025
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com