রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে সোহাগের কাছ থেকে টাকা চাইতো মাহমুদুল হাসান মহিন। লেনদেন করতো সোহাগও। আর সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক শত্রুতে পরিণত হয় জুনে। চাঁদা ফিক্সড করে চাওয়াতে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ও তর্কাতর্কি হয় গত ৭ জুলাই।
চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানো সোহাগকে সোজা করতেই মূলত মহিন ও টিটন গাজী পরিকল্পনা করে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার। চাঁদা না দিলে উল্টো পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হারাবে সোহাগ।
ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার পর মামলা থেকে বাঁচতে ‘মব’ তৈরির চেষ্টা করেন খুনিরা। তাই পূর্বপরিকল্পিতভাবে টেনে-হিঁচড়ে মিডফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে প্রকাশ্যে টেনে উল্লাসে মাতে খুনিরা। লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল হামলায় অংশ নিতে।
পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) চত্বরে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যা মামলার প্রাথমিক পুলিশী তদন্তে ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এব্যাপারে কোতয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাসির উদ্দিন বলেন, চাঞ্চল্যকর সোহাগ হত্যার ঘটনায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
সোহাগ হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার সাতজন হলেন, মূলহোতা মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, মো. টিটন গাজী, আলমগীর ও লম্বা মনির, সজিব বেপারি ও রাজিব বেপারি।
হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার মূলহোতা মাহমুদুল হাসান মহিন রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার পরিকল্পনা, সোহাগকে ভাঙারি দোকানে হত্যা না করে মিটফোর্ড চত্বরে ধরে এনে প্রকাশ্যে হত্যা, তারেক রহমান রবিন ও টিটনের সঙ্গে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, অস্ত্র সংগ্রহের পরেও নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং হত্যার পর উল্লাস করার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
ইতোমধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তারেক রহমান রহমান রবিন। গ্রেপ্তার টিটনসহ অন্য আসামিরাও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ ও বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
খোঁজ নিয়ে ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার রজনী বোস লেনের কিছুটা ভেতরে সোহাগের দোকান। গত ৭ জুলাই চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে সোহাগ ও মহিনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করলে সোহাগ পুলিশকে জানায় মহিনের সঙ্গে ঝামেলা মিটে গেছে। কিন্তু মহিন চুপ থাকেনি, টিটনের সঙ্গে পরামর্শ করে উল্টো হত্যার পরিকল্পনা করে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মহিন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন, সোহাগ খুবই একরোখা স্বভাবের ছিল। এলাকার অনেকে সোহাগের ওপরে ছিল ক্ষিপ্ত। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে চিরতরে সোহাগকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। শুরুতে তাকে দোকানেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সোহাগ খুনে অস্ত্রও সংগ্রহ করা হয় ছোট মনিরের মাধ্যমে। কিন্তু তারা সাম্প্রতিক মবের ঘটনা দেখে উৎসাহিত হয়। তাদের ধারণা ছিল, সোহাগকে মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের সামনে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে যদি অনেকে মিলে উল্লাস করা যায়, তাহলে ঘটনা মব হিসেবেই অন্যদিকে মোড় নেবে।
আর ওই এলাকার ভাঙারি ব্যবসায়ী, অন্যান্য ব্যবসায়ী, অ্যাম্বুলেন্স চালক, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে পাবে কড়া বার্তা। মহিন গ্রুপের কথা না শুনলে পরিণতি হবে এমনই ভয়াবহ।
এই চিন্তা থেকেই গত বুধবার (৯ জুলাই) সোহাগ দোকানে আসার পরেই ৭টি বাইকে করে ১৯ জন মিলে রজনী বোস লেনে প্রবেশ করে। এরপর সোহাগকে মারধর করতে করতে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ইট-বালু-সিমেন্টের তৈরি পাথর সদৃশ কনক্রিট দিয়ে বার বার আঘাত হত্যা করা হয়।
এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতেই মরদেহ টেনেছিঁচড়ে গেটের বাইরে এনে নৃত্য উল্লাসের মতো নৃসংশ দৃশ্যের অবতারণা করা হয় পরিকল্পিতভাবেই।
‘সোহাগ বাঁচলে আমরা শেষ’ বলে হামলায় সবাইকে ডাকে মহিন
প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাম্বুলেন্স চালক জানান, সোহাগকে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে মারতে দেখি। আশেপাশে অনেকেই ছিল। সবাই প্রথমে মারেনি। মহিন সবাইকে বলতে থাকে- ‘ও (সোহাগ) বাঁচলে আমরা শেষ’। এরপর সোহাগকে সবাই মিলেই যেন হামলে পড়ে। এরপর টেনেহিঁচড়ে মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের ভেতরে নিয়ে যায়।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা ডিবির এক এডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, মহিন, টিটন ও রবিন গেঞ্জাম লাগছে বলেই কিন্তু সবাইকে ডাকা হয়েছিল। সবাই জানতো না সোহাগ হত্যার প্ল্যান।
তিনি বলেন, আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ঘটনায় জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
অস্ত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতয়ালী থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) মনির হোসেন জীবন বলেন, অস্ত্রসহ রবিনকে গ্রেপ্তারের পর সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। রবিনের দেওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
অস্ত্র মামলার তথ্য : সোহাগ হত্যায় অস্ত্র সাপ্লাই দেয় ছোট মনির
আইনে দায়ের অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোহাগকে হত্যা করতে রবিন অস্ত্রটি ছোট মনিরের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল। অস্ত্র দেওয়ার সময় ছোট মনির বলেছিল, কাজ শেষ হলে সেটি ফেরত দিয়ে আসতে। তবে ফেরতের আগেই ধরা পড়ে রবিন। হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার রবিনকে অস্ত্র মামলার বিষয়ে মহিন ও টিটনের সঙ্গে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
সোহাগ হত্যায় জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। তদন্তে যদি বড় কোনো মাফিয়া, প্রভাবশালী বা কোনো নেতার সংশ্লেষ পাই তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মামলার প্রত্যেক আসামিকেই গ্রেপ্তার করা হবে।
বন্ধ সোহাগের ‘সোহানা মেটাল’ দোকানটি
মিটফোর্ড হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, রজনী বোস লেনের পুরোটা জুড়েই ভাঙারি দোকান। অধিকাংশই খোলা দেখা গেলেও বন্ধ সোহাগের সেই ‘সোহানা মেটাল’ নামে দোকানটি।
হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরা, সেনাবাহিনীর টহল। রাজনৈতিক সংশ্লেষ আর চাঁদাবাজির হিসাব-নিকাশ সব ছাপিয়ে এখনো জনসাধারণের মধ্যে আলোচনা হত্যার নৃশংসতা নিয়ে।
সোহাগের কয়েক দোকান পরের এক ভাঙারি ব্যবসায়ী বলেন, এলাকাটিতে মহিনের মতো আরও ৫-৬টি গ্রুপ রয়েছে। মহিন গ্রেপ্তার হলেও অনুসারী ওই গ্রুপগুলো তাদের হুমকির কারণ। যেভাবে সোহাগকে ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাকে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ভাঙারিসহ সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
ব্যবসায়ীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, সোহাগকে যে নৃশংসতার মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাতে যেকেউ আতঙ্কিত হতে পারেন। তবে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, ব্যবসায়ীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করে কথা বলেছি। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
থানার পাশাপাশি তদন্তে সহযোগিতা করছে ডিবি
যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জানান, চাঞ্চল্যকর সোহাগ হত্যা মামলার তদন্ত করছে ক্রাইম ডিভিশন। তবে আসামীদের সনাক্ত, গ্রেপ্তারসহ সার্বিক তদন্তে সহযোগীতা করছে ডিবি পুলিশ।
আনসার সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ ভিত্তিহীন: ডিজি
রোববার (১৩ জুলাই) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা দায় ছিল না।
ঘটনার দিন আনসার সদস্যরা হাসপাতালের নির্ধারিত রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন। রোস্টারের বাইরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গেটেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই, সেখানে গেটের বাইরে স্বপ্রণোদিত হয়ে আনসার সদস্যদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না।
তিনি আরও বলেন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মোট নিয়োজিত আনসার সদস্যের সংখ্যা ৮০ জন। এরমধ্যে রোস্টার অনুযায়ী, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ২৪ স্পটে দায়িত্ব পালন করেন ২৫ জন আনসার সদস্য।
হাসপাতালের কোথায় কীভাবে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন সেটা নির্ধারণ করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথা, ডিরেক্টর ও ডিডি (প্রশাসন)। সোহাগ হত্যার ঘটনা বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। তখন ঘটনাস্থল ৩ নম্বর গেটে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কোনো আনসার সদস্যকে রাখেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুতরাং সোহাগ হত্যার ঘটনায় আনসার সদস্যদের অবহেলা বা ব্যত্যয় দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ