শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ০৬:৫৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ
ভুল ধরলেই আপনি জামায়াত-শিবির ট্যাগ খাবেন : সারজিস আউটসোর্সিং শিল্প বিকাশে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে: শিল্প উপদেষ্টা মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দেশ : উপদেষ্টা সাখাওয়াত ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে : তুলসি গ্যাবার্ড ‘বাঁশ-বেতসহ কাঠের বিকল্প বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে কাজ করছে সরকার’ বিচার বিভাগের জাতীয় সেমিনার রবিবার, থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা ইসি যতই স্বাধীন হোক, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন সম্ভব নয় আমাদের প্রিয় জাতি সাহসিকতার সঙ্গে শক্তি প্রদর্শন করেছে: খামেনি ময়মনসিংহে বাস-মাহিন্দ্রা সংঘর্ষ, নিহত ৫ নির্ভুল মানচিত্রায়নের মাধ্যমে টেকসই সমুদ্রনীতি গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলে কেন এতো ভারতীয়, কী করেন তারা

বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫
  • ১৫ বার পড়া হয়েছে

আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনের মাসে বাড়ি যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।’ ইসরাইলের তেলআবিব থেকে বিবিসি বাংলাকে এভাবেই বলছিলেন রাঘবেন্দ্র নাইক নামের এক ভারতীয় নাগরিক।

সেখানে তিনি কেয়ার গিভারের কাজ করেন। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা তিনি, কর্মসূত্রে ইসরাইলে আছেন গত ১৩ বছর ধরে। ইসরাইয়েল ও ইরানের সংঘাতের মধ্যে উদ্বেগে রয়েছেন নাইক।

রাঘবেন্দ্র নাইক বলেন, রাতে কান খাড়া করে থাকতে হয়, কখন সাইরেন বাজে। সাইরেনের আওয়াজ শুনলেই ভূগর্ভস্থ শেল্টারের দিকে দৌড়াই। গত কয়েক রাত আমি বা আমার আশপাশের কেউই ঘুমাতে পারিনি। যে হারে ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা হচ্ছে, তাতে এক এক সময় ভয় হয়, ফিরতে পারব তো?

ইসরাইল তেলেঙ্গানা এসোসিয়েশনের সভাপতি সোমা রভির গল্পটাও প্রায় একই। তেল আবিবের কাছেই থাকেন তিনি।

রভি বলছিলেন, গত সপ্তাহে আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে এসেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না। প্রায় ২০ বছর আগে ইসরাইল এসেছিলেন কাজের সূত্রে রভি।

তাদের মতো আরও অনেক ভারতীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষই ইসরাইলে থাকেন। ইসরাইল ও ইরানের সংঘাতে ইরান থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।

ভারতের পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আটকে থাকা ভারতীয়দের ইসরাইল থেকে স্থল সীমান্ত হয়ে প্রথমে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে। তারপর সেখান থেকে বিশেষ বিমানে তাদের দেশে ফেরানো হবে। তেল আবিবের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে নজর রাখবেন। যারা ফিরে আসতে চান, তাদের ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলা হয়েছে।

কাজ বা পড়াশোনার জন্য বহু ভারতীয়ই ইসরাইলে রয়েছেন। ভারতের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ২০০০০ হাজার কর্মী ইসরাইলে আছেন। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।

ওই দেশে ভারতীয় কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই কেয়ার গিভারের কাজ করেন। তাছাড়া, নির্মাণ শ্রমিক হিসাবেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ভারতীয়ই ইসরাইলে পাড়ি দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে নার্স, কেয়ার গিভার এবং অদক্ষ শ্রমিকের জন্য ইসরাইল কিন্তু ভারতীয়দের উপরই নির্ভরশীল। ইসরাইলের প্রবীণ নাগরিকদের একটা বড় অংশই এই কেয়ার গিভারদের উপর নির্ভর করেন।

অশীতিপর নিসিন মোসেরি মুম্বাই থেকে ইসরাইল গিয়েছিলেন ১৯৬৩ সালে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমার ছেলেরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। আমার দেখাশোনা তো বটেই, সাইরেন বাজলে বোমা থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থলে যেতে হলেও আমাকে আমার কেয়ার গিভারেরই সাহায্য নিতে হবে।

ইসরাইলে ভারতীয়দের সংখ্যা

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরাইলে আছেন। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই অনুমান করা হয়। কারণ, ২০২৩ সালে ভারতের সঙ্গে সে দেশের চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায়, বহু ভারতীয় কর্মী সেখানে গেছেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরমধ্যে ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত, ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় কর্মী ইসরাইলে পৌঁছেছেন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োগ করেছে।

পাশাপাশি ১৯৫টি ইসরাইলি কোম্পানিতেও ভারতীয় কর্মী নিয়োগ হয়েছে। নির্মাণকর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই নির্মাণ খাতে নিযুক্ত, কাঠামো নির্মাণ, লোহা বাঁকানো এবং প্লাস্টার করার মতো কাজ করেন।

এরপর গতবছর ইসরাইল নির্মাণকর্মী এবং কেয়ার গিভার মিলিয়ে প্রায় ১৫,০০০ ভারতীয় কর্মী সে দেশে পাঠানোর অনুরোধ জানায় ভারতকে। তাদের মধ্যে কতজন ইসরাইলে কাজে যোগ দিয়েছেন, সে বিষয়ে জানা যায়নি।

কী কাজ করেন সেখানে তারা

ইন্ডিয়ান ইকনোমিক ট্রেড অর্গানাইজেশন-এর প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবাল বলেছেন, ভারত থেকে মূলত কেয়ার গিভারের কাজ করেন তারা। মেল নার্স, নার্সিং অ্যাসোসিয়েট হিসাবে ভারতীয়দের চাহিদা রয়েছে। ইসরাইলে প্রবীণ নাগরিকদের দেখাশোনা করার মানুষের অভাব। তাই ভারত থেকে, বিশেষত দক্ষিণ ভারত থেকে বহু ব্যক্তি কেয়ার গিভারের কাজ করেন। এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

তিনি বলছেন, দ্বিতীয় যে সেক্টরে এখন কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। সেটা হলো, কন্সট্রাকশন। ইসরাইলের বিভিন্ন অংশে ভবন তৈরি, মেরামতের কাজে বহু ভারতীয় কর্মী নিযুক্ত। ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ পুনর্গঠনের জন্যও কর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। তবে এই কর্মীদের সংখ্যাটা নার্সের তুলনায় অনেকটাই কম। এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক হলেও কর্মী রয়েছেন।

কেন ইসরাইলমুখী ভারতীয়রা?

ইসরাইলকে কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেওয়ার কী কারণ, জানতে চাইলে ম্যাঙ্গালরের বাসিন্দা পিএন লরেন্স বলেন, এখানে মাইনে অন্যান্য অনেক দেশের চাইতে ভাল। আমি ইসরাইলে ১৩ বছর কেয়ারগিভারের কাজ করার পর সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এসেছিলাম, কিন্তু ইসরাইলে ফিরে যাব ঠিক করেছি।

পিএন লরেন্স আরও বলেন, যুদ্ধের কথা মাথায় রেখেও বলব, ইসরাইল কাজের জায়গা ভাল। এখানে সরকার বিদেশি কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা-সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়, যা অন্য দেশে নেই। এখানে আমরা যা আয় করি, তার উপর ভারতে থাকা আমাদের পরিবার নির্ভর করে। কোথায় যাব?

পেঠা টিকোয়ার যে অংশে ইয়াকভ টকার থাকেন, সেখানে আরও অনেক ভারতীয়ই থাকেন। মুম্বাই থেকে ১৯৬৩ সালে ইসরাইলেয়ে আসা টকার বলেন, গত ২০-২২ বছর ধরে ভারতীয় কর্মীদের সংখ্যা বেড়েছে, মূলত কেয়ার গিভারদের। তার কারণ, পরিবারের সবাই কাজ করেন। বাড়ির বয়স্কদের দেখাশোনার কেউ নেই। এর আগে এত সংখ্যক ভারতীয় কর্মী কিন্তু ইসরাইলে দেখা যেত না।

তেল আবিবে বাস করেন বেন্নি নাইডু। পেশায় ব্যবসায়ী তিনি। ম্যাঙ্গালোর থেকে ইসরাইলে এসেছিলেন ৯০-এর দশকে।

তিনি বলেছেন, তেল আবিব বা তার নিকটবর্তী অঞ্চলেই ভারতীয়রা বাস করেন। যারা কেয়ার গিভার তারা গোটা সপ্তাহ কাজ করার পর সপ্তাহান্তে ভাড়া করা বাড়িতে ফেরেন। সেই সময় আমার দোকানে আসেন কথাবার্তা হয়। আমরা সমস্ত উৎসব একসঙ্গে উদযাপন করি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সকলেই উদ্বেগে আছি।

তার মতে, গাজা নিয়ে সংঘাতের সময় থেকেই ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। ইরানের সঙ্গে সংঘাতের পর পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়েছে এটা স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।

নাইডু বিয়ের পর দেশ ছাড়েন। তার কথায়, আমার স্ত্রী ইহুদী। বিয়ের পর এখানে চলে আসি। নাগরিকত্ব নিই। প্রথমে টেলিফোনের একটা কোম্পানিতে কাজ করতাম। পরে ব্যবসা শুরু করি। আমার তিন ছেলে। দু’জনই মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দিয়েছে, ছোটজনও দেবে। আমিও এখানকার নাগরিকত্ব নেওয়ার পর মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দিয়েছি।

‘চতুর্দিকে মৃত্যু ফাঁদ। কোথায় যাব’

এই মুহূর্তে ইসরাইলের পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে রাঘবেন্দ্র নাইক বলেন, ইসরাইলের পরিস্থিতির কথা নতুন করে কী বলব। আগে সাইরেন শুনলে এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকতাম কিন্তু এখন ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার খুঁজি কারণ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিশালী।

ইয়াকভের বাড়ির কাছাকাছি দু’টো বাড়ি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তিনি বলেন, গাজায় সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর এক সময় যেমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, তেমনই এটাও অভ্যেস হয়ে যাবে। আমাদের চতুর্দিকে মৃত্যু ফাঁদ। কোথায় যাব?

ইসরাইলস্থিত ইন্ডিয়ান জিউইশ কমিউনিটি সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ওয়াস্কার জানিয়েছেন, তার পরিচিত কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে সাম্প্রতিক হামলায়। তিনি বলেন, আমার পরিচিত কয়েকজনকে দিন কয়েক আগে হারিয়েছি। তার মধ্যে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া তরুণপ্রজন্মও আছে।

তার নাতনি স্তাভ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানে মেয়েদেরও সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। আমি দুই বছর আগে আমার মেয়াদ শেষ করেছি। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি হয়তো আবার যেতে হতে পারে।

এই সমস্ত কিছুর মাঝেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন নাইক। তিনি বলেন, আমি ঠিক করেছি পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে ভারতে ফিরে যাব। সেখানেই কাজ খুঁজে নেব। আগে বছরে একবার অন্তত দেশে যেতে পারতাম কিন্তু একের পর এক সংঘর্ষের কারণে সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এখন ভয় হয়।

বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2018-2025
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com