দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় সমালোচনার মুখে পড়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিদেশি বিনিয়োগের বড় ধরনের পতনের মধ্যে চীন কিছুটা চাপমুক্ত করতে পারে সরকারকে। আর সেটি হতে পারে চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও’র ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে।
ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর বিশাল দল নিয়ে আজ (শনিবার) ঢাকা সফরে আসছেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বড় কোনো বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে সরকার খোশ মেজাজে রয়েছে। কেননা, চীনা প্রতিনিধিদল দলের সফরে কিছু বিনিয়োগের ঘোষণা আসবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনা প্রতিনিধিদলের সফরে বিনিয়োগের ঘোষণা এলে সেটি সরকারের জন্য স্বস্তির হবে। একইসঙ্গে গ্যাস সংকট, কর এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে থাকা উদ্বেগের কথা তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, চীনা বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা ১০০ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর দুজন সদস্য নিয়ে মোট ২০০ জন এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও’র সঙ্গে চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশাল বহর আজ দুপুরে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ঢাকায় এসে চীনা প্রতিনিধিদল বিকেলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
পরদিন রোববার তারা পাঁচটি সেশনে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে ম্যাচমেকিং করার কথা, যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। আগামী ২ মে (সোমবার) বাংলাদেশ-চীন যৌথ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য কমিশনের বৈঠক। বাংলাদেশের পক্ষে বৈটকের নেতৃত্ব দেবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অন্যদিকে, চীনা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন ঢাকা সফরররত দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও। ওইদিন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চীনা ব্যবসায়ীদের ম্যাচমেকিং সভা করার কথা রয়েছে। একই দিন চীনা ব্যবসায়ীদের একটি অংশ গাজীপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শনের কথা রয়েছে।
সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, চীনা বাণিজ্যমন্ত্রীর সফরের মূল লক্ষ্য যৌথ বাণিজ্য কমিশনের বৈঠকে যোগ দেওয়া। সেইসঙ্গে চীনা ১০০ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর দুজন সদস্য নিয়ে মোট ২০০ জন আসবেন। আশা করা হচ্ছে, চীনা ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের কিছু ঘোষণা দেবেন। কিছু বিনিয়োগের ঘোষণা আসবে বলে আমরা জানতে পেরেছি, তবে কি পরিমাণ বিনিয়োগ আসতে পারে সেটি আগাম বলতে পারছি না।
বিডা সূত্র বলছে, চীন বাণিজ্যমন্ত্রীর সফরে দ্বিপাক্ষিক আমদানি-রপ্তানিতে যে কোনো প্রকার বাধা দূরীকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হতে পারে। গত মার্চে চীন এ সমঝাতা স্মারকের খসড়া ঢাকায় পাঠিয়েছে।
চীনা মন্ত্রীর সফরে বিনিয়োগ আসা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছিলেন, চীন কত বিনিয়োগ করবে সেটা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। কারণ সিদ্ধান্তটা তারা নেবে। আশা করছি, চীনা প্রতিনিধির এ সফর বিফলে যাবে না।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রবর্তিত বিনিয়োগ পরিবেশ, বাণিজ্য ও শ্রম সম্পর্কিত সংস্কার বাংলাদেশে আরও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং চীনের আরও উৎপাদন কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর সহজতর করবে। গত ৯ মাসে আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে বিনিয়োগ সহজ করার।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগের এমন অনুকূল পরিবেশ আগে কখনো ছিল না। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রতি মাসের ১০ তারিখে কোরিয়ান ও চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মাসিক প্রাতরাশ বৈঠকের আয়োজন করবেন। বিডার আয়োজনে এসব বৈঠক হলেও প্রধান উপদেষ্টা বিনিয়োগকারীদের উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয় শোনার জন্য সেগুলোর কয়েকটিতে অংশ নেবেন।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধান করে প্রধান উপদেষ্টা তাদের জন্য একটি হটলাইন ও কল সেন্টার সার্ভিস স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন। চীনা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মোংলায় পরিকল্পিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যেখানে চীন একটি সমুদ্রবন্দর আধুনিকায়ন করতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশকে একটি শীর্ষ বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশকে তাদের দক্ষিণ এশিয়ার উৎপাদন ও অপারেশন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিছু বৃহত্তর চীনা প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) রূপান্তর, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি উৎপাদন, বায়ু বিদ্যুৎ এবং অফশোর ফটোভোলটাইক সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘদিন ধরেই এফডিআইয়ে গতি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ (জুলাই-মার্চ) মাসে ৮৬ কোটি ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৬ কোটি ডলার। তার মানে এ সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৬ শতাংশ।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি ৩৭ শতাংশ শুল্কের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ শুল্ক আপাতত স্থগিত রাখলেও দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে না পারলে কার্যকর হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী ঢাকায় আসার আগে জাপান সফররত বাংলাদেশের সরকারপ্রধান জাপানের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম নিক্কেই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তুলা, তেল ও গ্যাস কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। তিনি জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় এই প্রস্তাব ব্যবহার করা হবে। ট্রাম্পের পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
অন্যদিকে, গত এপ্রিলে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে নিজ দেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে ভারত। এরপর গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করে।
চলতি মাসের মাঝামাঝিতে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিদেশি বিনিয়োগের অবস্থা হতাশাজনক। বিনিয়োগ খরা চলছে। গ্যাস সরবরাহের অবস্থা ভালো না। বাংলাদেশে যেসব শিল্পকলকারখানা আছে তাদের জন্য গ্যাস নিয়ে টানাটানি।
নতুন করে যদি বিনিয়োগ আসে গ্যাস সরবরাহ হবে কী করে? ঈদের পর গ্যাস সরবরাহ কিছু বাড়বে, তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম হবে। নতুন বিনিয়োগ আসলে বাংলাদেশি যে বিনিয়োগ তার সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তখন গ্যাস সরবরাহ ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের খরচ অনেক বেশি। ওয়ান স্টপ সার্ভিসে বিনিয়োগ করতে গেলে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসব কারণে বাংলাদেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চান না। বিনিয়োগ খরচ, জ্বালানি সংকট-এ দুটো বাধাগ্রস্ত করছে বাংলাদেশকে। এখানে যদি পরিস্থিতির উন্নয়ন করা যায়, জ্বালানি সমস্যার সমাধান করা যায় এবং প্রচুর পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করা যায় তাহলে অনেকে হয়ত আগ্রহী হবে বিনিয়োগ করতে। একইসঙ্গে ব্যবসার খরচ কমাতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যদি চীন অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে তাহলে এটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটা সাফল্য হবে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে চীনা বিনিয়োগ যদি বাংলাদেশে আসে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেনশন তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের।
এটা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কোনোভাবে চাইব না যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হোক। চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলে আমার মনে হয়। প্রচুর চীনা বিনিয়োগ আসতে থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য কোনো সমস্যা তৈরি করে কি না, সেটা দেখতে হবে। আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ