আকাশী নদী নিয়ে গত কয়েক দশক ধরেই আলোচনা চলছে। এই আলোচনা এখন ভয়ে রূপ নিয়েছে। কারণ জমিনের নদী শাসন করা যায়, আকাশী নদী যায় না। এমনকি ভয়াবহ বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ানো এই নদী এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার আতঙ্ক।
উড়ন্ত নদী (ফ্লাইং রিভার) বা আকাশী নদী (স্কাই রিভার) নাম হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে এটি পরিচিত বায়ুমণ্ডলীয় নদী বা অ্যাটমসফেরিক রিভার নামে। গত বছর ফেনী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বন্যা বা তার আগের বছর সুনামগঞ্জ ও সিলেটে যে ভয়াবহ বন্যা, তার জন্য দায়ী করা হচ্ছে এই উড়ন্ত নদীকে। চলতি বছর ভারত ও বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার কারণ হতে পারে এই বায়ুমণ্ডলীয় নদী।
গত কয়েক বছরে এই উড়ন্ত নদীর কারণে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় শুষ্ক অঞ্চলেও বন্যা দেখা দেয়, যা অনেকটা কল্পনাতীত। এ কারণে বায়ুমণ্ডলীয় নদী সম্পর্কে আমাদের জানা জরুরি।
কী এই ‘বায়ুমণ্ডলীয় নদী’
সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উষ্ণ সমুদ্রাঞ্চলে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প তৈরি হয়। এটি সবারই জানা যে, বাষ্প মেঘ হয়ে জমাট বাধে এবং শীতল অঞ্চলে পৌঁছে বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু অতিরিক্ত তাপ ও বাষ্প হওয়া পানি খুব দ্রুত মেঘের স্তরে জমতে থাকে এবং বিশাল অঞ্চল জুড়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে এই মেঘ তৈরি হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত এমন আকাশ-নদীর একটির খোঁজ পাওয়া গেছে অ্যামাজনে, যেখানে হওয়া বৃষ্টিপাতের কারণে সজীব থাকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ দেশ।
আবহাওয়াবিদদের মতে একটি বায়ুমণ্ডলীয় নদী গড়ে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ, ৫শ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং ৩ কিলোমিটার গভীর হয়। কখনও কখনও এটি ৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে।
২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এই উড়ন্ত নদী থেকে ২০০-৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০২৩ সালের এক আকাশ-নদী প্রবাহে এক দিনে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে গত ২২ জুন ১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।
যার প্রভাবে হঠাৎ বন্যা হয় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ফেনী অঞ্চলে। এই বৃষ্টির প্রভাবে বাংলাদেশে বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হলেও, মাত্র ১ দিনের ব্যবধানে কুশিয়ারা নদীর অমলশীদ পয়েন্টে পানি বেড়ে যায় ১৯১ সেন্টিমিটার। আবহাওয়াবীদদের ভাষ্যমতে, ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা ১০ দিনব্যাপী বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ইদানীং কেন এত ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে আকাশ নদী
সহজ কথায় বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে হঠাৎ বন্যা (flash flood), প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রাণহানির ঘটনা। চলতি বছরেও হঠাৎ বন্যায় ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হর্ষিলে ৯ সেনা সদস্য নিখোঁজ হন।
বৈশ্বিক উষ্ণ তাপমাত্রার প্রভাবে জেট স্ট্রিমে যে পরিবর্তন আসছে, তার কারণেও গতিপথে পরিবর্তন এনে এই বৃষ্টি ভিন্ন অঞ্চলে প্রবাহিত হচ্ছে। যেমন পাকিস্তানের খরা অঞ্চলে হঠাৎ বৃষ্টির ঘটনা!
বাংলাদেশে আকাশ-নদীর প্রভাব
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা ও স্যাটেলাইট উপাত্তের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশে আকাশ-নদীর প্রভাবে বন্যার তীব্রতা বাড়ছে। এটি আগস্টে আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এই আকাশ-নদীর প্রভাবে শুধু আগস্ট নয়, সেপ্টেম্বর মাসেও বন্যা পরিস্থিতি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ ফেসবুকে জানিয়েছিলন, বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ থেকে ১০টি জেলা এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে (আগামী ৩ দিনের মধ্যে) ১০ থেকে ১৫টি জেলা বন্যা কবলিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের যে জেলাগুলোর মধ্যদিয়ে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহিত হয়, বৃহস্পতিবার ইতিমধ্যেই রংপুর বিভাগের তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে।
ফলে আজ থেকে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা জেলার অনেক এলাকা বন্যাকবলিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে। আগামী রোববার (১৭ আগস্ট) থেকে রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, ময়মনিসংহ বিভাগের ১৫ থেকে ২০টি জেলা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে।