তিস্তার ভাঙনে বিগত ১০ বছরে চার লাখের বেশি মানুষকে বাস্তচ্যুত করেছে। একই সময়ে ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ কোটি টাকার সম্পদ। তিস্তার ৪৫ কিলোমিটার ভাঙন প্রবণ এবং ২১ কিলোমিটার অতি ভাঙন প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব এলাকার অবকাঠামো, ফসলিজমি, বসতভিটা ও গাছপালা প্রতি বছর নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।
এ ছাড়া তিস্তার অন্যান্য এলাকায় কমবেশি ভাঙন রয়েছে। প্রতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করে। তিস্তা নিয়ে মহাপরিকল্পনাসহ উন্নয়নে নানান কথা শোনা গেলেও বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না। অথচ প্রতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন ঠেকাতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে।
বিগত ১০ বছরে ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছে সেই টাকা দিয়ে এতদিন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়ে যেত। এমনটা মনে করছেন নদী নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা। এসব তথ্য পাওয়া গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ ও নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের নেতাদের কাছ থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিনে গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চর শংকরদহে এলাকার তহর উদ্দিন, আবদুর রশীদ, ফরিদ মিয়া, আলিমুদ্দিন, রবিউল ইসলামসহ কমপক্ষে ১০ জনের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তারা এখন অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে ওই এলাকার প্রায় ৭০ একর জমির ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি কুমড়ার খেত নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ১১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগ এলাকাই ভাঙন প্রবণ। তিস্তা পাড়ে ফরিদ মিয়া, আলিমুদ্দিন জানান, ভাঙনের শিকার হয়ে তারা ৫-৬ বার বসতের স্থান পরিবর্তন করেছেন। তাদের মতো হাজার হাজার মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বাস্তচ্যুত হচ্ছেন।
এসব মানুষ নদী পাড়ের নির্মিত বাঁধে অথবা অন্য কোনো স্থানে বাস্তচ্যুত হিসেবে বাস করছেন। একসময়ের আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিটি ভাঙনের শিকার হয়ে দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এক সময় যারা মানুষকে দান করতেন তারা এখন অন্যের অনুগ্রহে বেঁচে রয়েছেন।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদী নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এর দৈর্ঘ্য ১১৫ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই নদীর ৪৫ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২১ কিলোমিটার ।
নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, প্রতি বছর ভারত পানি আটকে রেখে হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ার কারণে বড় বড় বন্যা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এই অমানবিক আচরণের কোনো প্রতিবাদও আমরা দেখতে বা শুনতে পাই না।
রংপুর অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ তিস্তার ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। তারা অপেক্ষা করে আছে একদিন তিস্তা চুক্তি হবে, তিস্তা নদী সুরক্ষায় কার্যকর পরিচর্যা হবে। নদীপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত এবং আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ নদীর ভাঙন আর বন্যা থেকে মুক্তি চায়। গত দশ বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সময়ে প্রায় চার লাখের বেশি মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তায় প্রতি বছর ১ লাখ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘তিস্তা কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা জরুরি। সরকারিভাবে ‘তিস্তা বন্ড’ চালু করা। রংপুর বিভাগের উন্নয়ন বৈষম্য নিরসনে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
তিস্তা মহাপরিকল্পনার অর্থায়নে সারচার্জ নির্ধারণ করা। তিস্তা অববাহিকার পাঁচ জেলায় আদায়কৃত রাজস্ব তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ব্যবহার করা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থ তিস্তা মহাপরিকল্পনার অর্থায়নে যুক্ত করার দাবি করেন।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আহসান হাবিব বলেন, তিস্তার প্রায় ২১ কিলোমিটার এলাকা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই সব এলাকার প্রতি বছরই নদী ভাঙে। তবে কী পরিমাণ জমি নদীগর্ভে যায় এরং কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় এর কোনো পরিসংখ্যান পানি উন্নয়ন বোর্ডে নেই।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ