চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয়বহুল ওষুধ জেনেরিক নাম লিখতে বাধ্য করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন। একইসঙ্গে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব ওষুধের প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ও ব্র্যান্ড উভয় নামই অন্তর্ভুক্ত করাও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়।
এটি করতে পারলে সঠিক ওষুধ লেখার ব্যাপারে স্বচ্ছতা বাড়বে, রোগীরাও সহজে বুঝতে পারবে। সরকারি ও বেসরকারি ফার্মেসিতে সঠিক ওষুধ বিতরণ নিশ্চিত করতে এ পদ্ধতি কার্যকর হবে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।
জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খানের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত ১২ সদস্যের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন সদস্যরা গত ৫ মে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেন।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ ছাড়া বিএমডিসি রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ওষুধ বিতরণ করা যাবে না। ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধের তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ করে প্রত্যেক ফার্মেসিতে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করতে হবে।
প্রতিবেদনের স্বল্প মেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) কর্তৃক বর্তমানে বিদ্যমান ওষুধের গুণাগুন পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারগুলোর (ল্যাবগুলোর) সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে নতুন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
চলমান ভ্রাম্যমাণ ‘মিনি ল্যাব’ ভ্যান স্থাপন করতে হবে, যেন দূরবর্তী এলাকাগুলোতে ওষুধের মান পরীক্ষা করা যায়। এই ল্যাবগুলোতে ওষুধের মান ভেজাল শনাক্তের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এছাড়াও সাশ্রয়ী ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত রাখতে, দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতা জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে অস্থায়ী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চুক্তি করা এ ট্রিপ সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য নতুন উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা করতে হবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সরকার ও ব্যক্তিগত অংশীদারত্বের মাধ্যমে গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন: প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব (যেমন: এফডিএ বা ইএমইডিএজেন্সি) বাড়াতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে যেন উচ্চমানের ও সাশ্রয়ী ওষুধ দেশেই উৎপাদন করা যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাবিষয়ক সুপারিশে বলা হয়, সকল ওষুধ প্রস্তুতিতে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাক্টিস (জিএমপি) পদ্ধতি অনুসরণ নিশ্চিত করতে একটি দক্ষ এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কাঠামো গঠন করতে হবে। জাতীয় ই-প্রেসক্রিপশন পোর্টাল চালু করতে হবে, যা সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে সংযুক্ত ও সমন্বিত থাকবে এবং যা প্রেসক্রিপশনের কার্যকারিতা, ওষুধের অবস্থিতি ও স্থিতি অনুসরণ (ট্র্যাকিং) এবং জবাবদিহিতা বাড়াবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের মধ্যম- দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের ক্ষেত্রে বলা হয়, ওষুধের পুনঃবিতরণ এবং অপব্যবহার রোধে, জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্ট কার্ড বা জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে সংযুক্ত ডিজিটাল রোগী শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যার মাধ্যমে ওষুধের বিতরণ নিয়ন্ত্রিত ও অনুসরণযোগ্য (ট্র্যাকযোগ্য) হবে। দেশের ভেতরে নীতিগত সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক উৎকৃষ্টতা অনুশীলনের সমন্বয়ের মাধ্যমে উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা জোরদার করতে হবে, যেন একটি সাশ্রয়ী, দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
সাশ্রয়ী মূল্যের জেনেরিক ওষুধ:
সরকারের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ওষুধের অন্তত ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে জেনেরিক ওষুধ ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। একই জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে একাধিক প্রস্তুতকারকের অংশগ্রহণের ফলে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যা মূল্য হ্রাসে সহায়ক হবে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিবন্ধন, পেটেন্ট আবেদন বা বায়োসিমিলার উন্নয়ন—তাদের জন্য নতুন পণ্যের আয়ের ওপর করপোরেট কর ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ সুবিধা পেতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ডিজিডিএ-তে স্বচ্ছ পর্যায়ক্রমিক উন্নয়নভিত্তিক প্রতিবেদন প্রদান প্রতিবন্ধকতা কমাবে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং দেশীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক চিকিৎসা উদ্ভাবন দ্রুততর করবে সঙ্গে বাধ্যতামূলক হবে, যেন অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এই নীতিনির্ভর প্রণোদনা কাঠামো উদ্ভাবন আর্থিক বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে এবং উন্নত চিকিৎসা সহজলভ্য হবে।
সংস্কার প্রতিবেদনের সুপারিশে আরো বলা হয়, ওষুধের যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে—এর জন্য রোগীদের শিক্ষার উদ্যোগ, কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম, চিকিৎসক ও প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ, পলিফার্মেসি (একাধিক ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক্লিনিক্যাল অডিটের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশনের কঠোর নজরদারি চালু করতে হবে। ওষুধের বণ্টন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সমতা সংক্রান্ত ঘাটতি দূর করতে হবে। এর অংশ হিসেবে, আঞ্চলিক ইডিসিএল এবং ওষুধের গুদাম স্থাপন এবং অবহেলিত অঞ্চলে ওষুধের সরবরাহের জন্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ওষুধ ও টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যন্ত ফার্মাকোভিজিল্যান্স ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, পাশাপাশি, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রতিরোধে ব্লকচেইন বা অন্যান্য ট্রেসেবিলিটি প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
সংস্কার প্রতিবেদনের সুপারিশে আরও বলা হয়, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও সরবরাহ চ্যানেলগুলোর নিরাপত্তা মানদণ্ডে নিয়মিত মিল রয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা যায় সেজন্য নিয়ন্ত্রণমূলক তদারকি জোরদার করতে হবে।
সময়মতো পরিদর্শন ও কার্যকর লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। ডিজিডিএ কর্তৃক ওষুধ, সরঞ্জামাদি, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও কৃতিস্বত্ব (পেটেন্ট) এর নিবন্ধন এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
ডিজিটাল প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ইনভেন্টরি ট্র্যাকিং জোরদার ও চাহিদাভিত্তিক প্রক্রিয়াকরণ কৌশল বাস্তবায়ন, কেনাকাটার অনিয়মের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ এবং সব ধরনের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া সরবরাহ চেইন ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করতে হবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর চাহিদা পূর্বাভাস ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
সুপারিশ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রোগী ও সরবরাহ চেইনের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের পাশাপাশি তথ্য নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত ও শক্তিশালী তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন ও নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যেন সব অংশীদারদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়।
অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, টিকা ও চিকিৎসা সামগ্রীর টেকসই প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেমন টিপস সমাপ্তকালীন সময়সীমা নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ, বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিং পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ, ট্রিপস সুবিধার আওতায় নিম্নমূল্যের বাজার থেকে জেনেরিক ওষুধের সমান্তরাল আমদানি উৎসাহিত করা, দেশীয় ওষুধ গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ক্রয় ও বিতরণ কৌশলের উন্নয়ন (প্রয়োজনের নিরিখে বিতরণ), প্রয়োজনীয় অর্থায়ন এবং অর্থায়ন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণ, টিকা চুক্তির স্বচ্ছতা ও যথার্থতা নিশ্চিতকরণ;জাতীয় বাজেটভিত্তিক টিকা নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন, জাতীয় ওষুধ ও টিকা নীতিমালা প্রণয়ন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন, যা দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে, দেশের ভেতর মেশিন, যন্ত্রাদি, যন্ত্রের অংশ, কাঁচামাল, কেমিক্যাল, জারক, টিকা উদ্ভাবন ও তৈরি, দূর-চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা (টেলিমেডিসিন ও টেলিসার্জারি), তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণের সফটওয়্যার তৈরি ইত্যাদি, যা অতি উচ্চমূল্যের সেবার মূল্য হ্রাস করতে সাহায্য করবে ও ব্যবস্থাপনাকে সমুন্নত করবে এসব প্রচেষ্টায় ও উদ্ভাবনীতে সরকারকে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ