দুই বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায় রংপুরের নাসিমা আক্তারের, এরপর থেকেই তার সঙ্গী হুইল চেয়ার। শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়েও ২১ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
২০২২ সালে রংপুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নে সংরক্ষিত নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত নাসিমা দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধীদের প্রতিনিধিত্ব করতে চান। সেজন্য সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তিনি।
প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদের এই সভাপতি দেশের আইনসভায় প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা বলতে চান, তাদের জন্য আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনের মধ্যে আনুপাতিক হিসাবে ৪৮টি পাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বাকি ২টি আসন পাবে জাতীয় পার্টি।
৪৮ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দলটির ফরম তুলেছেন ১ হাজার ৫৪৯ জন নারী। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী রয়েছেন ৩ জন।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের মধ্যে অন্তত দুটি বরাদ্দ রাখার দাবি করেছেন এই তিন নারী।
তাদেরই একজন নারী অধিকার কর্মী, নির্মাতা ও লেখক জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি মনে করেন, সংরক্ষিত আসনে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য ‘কোটা’ রাখলে তা তাদের অধিকার বুঝে নেওয়ার পথ তৈরি করবে।
“সরকার যদি আমাদের জন্য একটা কোটাও চালু করে, তাহলে আমরা আমাদের প্রয়োজনগুলো বলতে পারব। আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের রোল মডেল হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদ ব্যবস্থার জন্য, আমাদের সেটাই দাবি। আমাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, কোনোভাবেই ছোট হবে না।”
আগুনে পোড়াজনিত প্রতিবন্ধিতার শিকার আইভি বিবিসির ২০২৩ সালে বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা পান।
দগ্ধতাজনিত প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা এই নারী বলছেন, প্রতিবন্ধী নারীদের অসুবিধাগুলো পুরুষরা বুঝতে পারেন না, অন্য নারীদের পক্ষেও বোঝা সম্ভব না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতে সংসদে গিয়ে নীতিমালা পুনর্বিন্যাসসহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় তিনি কাজ করতে চান।
প্রতিবন্ধিতা জয় করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা আইভি বলেন, “শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মের যোগ্যতা, সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা কোনোদিকেই পিছিয়ে নেই। আমরা সবই করছি, তাহলে আমাদের সংসদে অন্তর্ভুক্ত করতে সমস্যা কোথায়?
“আমরা যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি, ওটা যদি ওনারা দেখেন, অন্যান্য প্রার্থীদের তুলনায় আমাদের যোগ্যতা কি কম? যদি কম হয়, আমরা মেনে নেব।”
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সালমা মাহবুব নয় মাস বয়সে ধরে ধরে হাঁটতে শিখেছিলেন, ঠিক তখনই পোলিও আক্রান্ত হয়ে আর হাঁটা হয়নি তার। হুইল চেয়ারের মাধ্যমে চলাফেরা করা এই নারী ৫৬ বছর বয়সে এসে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হতে চান।
তবে ক্ষমতাসীন দলটির সবুজ সংকেত নিয়ে সংসদে যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে আপাতত ভাবছেন না সালমা। তিনি চান, আইনসভায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মানুষের নজরে থাকুক এবং জনপ্রতিনিধি হতে আরও প্রতিবন্ধী নারী এগিয়ে আসুক।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুবের পর্যবেক্ষণ, সংসদে অনেক বিষয়ে আলোচনা হলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এর বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। যা তাদের অধিকার বঞ্চিত করছে।
“প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানা সময়ে নানা দাবি করেন। কিন্তু সেটা কেউ সংসদে তুলে ধরেনি। আমাদের কথা শোনার কেউ নাই। সংসদে যদি আমি বা আমার মত কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই সে আমাদের কথা শুনতে আসত, যখন আমরা রাস্তায় কোনো দাবি নিয়ে চিৎকার করি। সেটাই আমি চিন্তা করছি যে, সংসদে ওই কণ্ঠস্বরটা আমার থাকবে।”
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করতে কেন বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে না, সে প্রশ্ন তুলেছেন সালমা মাহবুবও।
প্রতিবন্ধী নারীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরাও তো মনোনয়ন নিই না। না নিলে তো আমরা তাদের দোষ দিতে পারি না যে, আমি মনোনয়ন চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে দেয়নি।
২০১৪ সাল থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদের (পিএনএসপি) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন সালমা।
তিনি মনে করেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিনোদন, শিক্ষা, চাকরি, স্বাভাবিক জীবনযাপন- সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন প্রবেশগম্যতা না থাকার কারণে।
“আমরা যেহেতু মধ্যম আয়ের দেশ, আমরা যদি এই প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমাদের অনেক সুবিধা হবে। এটা শুধু প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তা নয়, এই সুবিধা পাবেন সব মানুষ।”
সমাজে প্রতিবন্ধীদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই উল্লেখ করে সালমা মাহবুব বলেন, “প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে কতগুলো কমিটি রয়েছে, সেগুলো সক্রিয় নয়। কোনো মিটিং হয় না। এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কোনো কথা বলতে পারে না। সেই কথাগুলো আমি সংসদে তুলে ধরতে চাই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন ফিল করতে পারে যে, তাদের জন্য কেউ একজন আছে।
“প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে নজর দেয়া হয় না। তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। প্রতিবন্ধীরা অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। আমরা সরকারের আরও মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।”
প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদের সভাপতি নাসিমা আক্তার মনে করেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীবান্ধব, যা আশা দেখাচ্ছে তাকে।
“প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলের অনেক নারীকে সংসদে সুযোগ করে দিবেন। আমাদের সংসদে স্থান দিয়ে উনি আমাদের কথাগুলো বলার যেন সুযোগ করে দেন, এটাই আমরা চাই।”
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ