জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করা হয়েছে। এতে অভিযোগ আনা হয়েছে, শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
রোববার (১ জুন) দুপুরে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করার সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট বিবরণ তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
প্রসিকিউশন থেকে ট্রাইব্যুনালে জানানো হয়, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগে সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে গণভবনে বসে হত্যা, ষড়যন্ত্র, সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ, আবু সাইদ হত্যা, চাঁনখার পুলে ছয়জনকে হত্যাসহ মোট ১৪০০ জনকে হত্যা, ২৫ হাজার নিরীহ মানুষকে আহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এসব অভিযোগে তিন লাখের ওপর গুলি ছোড়ার তথ্য রয়েছে এবং রাজধানী ঢাকাতেই ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি খরচ করা হয়েছে বলে
জানানো হয়।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে জানান, গত বছরের জুলাই-আগস্টে চলমান গণআন্দোলনের সময় নির্বিচারে সহস্রাধিক মানুষ হত্যায় তিনি নির্দেশদাতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সমর্থনে ১৩৫ পৃষ্ঠার মূল অভিযোগপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আরও ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিডিও, অডিও কল রেকর্ডিং, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতি ও অন্যান্য দালিলিক উপাত্ত।
১। প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিক্টিমদের সাক্ষ্য
২। অপরাধ সংগঠনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ
৩। ড্রোন এবং সিসিটিভি ফুটেজ
৪। আসামিদের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস
৫। ডিজিটাল এভিডেন্সসমূহের ফরেন্সিক রিপোর্ট
৬। আসামিগণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
৭। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও
৮। জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট
৯। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি।
শুনানি শেষে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এই মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাতে বলেন আদালত।
এ মামলায় পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গ্রেফতার রয়েছেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। আগামী ১৬ জুন এই মামলার তিন আসামিকে হাজির করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে রোববার (১ জুন) ট্রাইব্যুনাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার ও প্রসিকিটর মো. মিজানুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গাজী এমএইচ তামিম, আব্দুস সাত্তার পালোয়ান, প্রসিকিউটর ওমর ফারুক প্রমুখ।
চৌধুরী আবদুল্লাহ কারাগারে থাকলেও শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। এর আগে গত ১২ মে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। তদন্ত প্রতিবেদনে জুলাই গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে এসেছে।
শুনানিতে জুলাই আগস্টে সংগঘটিত হত্যাকাণ্ডে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্থার কর্মকর্তাদের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে জুলাই গণহত্যার নির্দেশদাতা পরিকল্পনায় সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে এসেছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।
তারই আলোকে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। মামলার অপর দুই আসামি হলেন ,সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন।
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ–নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। এতে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক আচরণের ঘটনা ঘটে।
আসামি শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ দেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন আসামি শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে। যা তাদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরীহ নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ এবং ১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ