গাজায় মার্কিন ও ইসরায়েল সমর্থিত একটি বিতর্কিত গোষ্ঠীর নতুন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ভিড় জমিয়েছেন। কেন্দ্রটি কাজ শুরু করার একদিনের মাথায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
ভিডিওতে দেখা গেছে, রাফাহ শহরের গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ কম্পাউন্ডে লোকজন কাঁটাতারের বেড়া ও মাটির বাঁধ ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ছে।
জিএইচএফ জানিয়েছে, এক পর্যায়ে ত্রাণ প্রত্যাশীদের তুলনায় বিতরণ কর্মীদের অনেক কম হওয়ায় তাদের দলকে পিছু হটতে হয়। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, এই ভিড় সামলাতে তাদেরকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তেও হয়েছে।
জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে জিএইচএফ নামক এই ত্রাণ বিতরণ সংস্থাটি সশস্ত্র মার্কিন নিরাপত্তা কর্মী (ঠিকাদার) ব্যবহার করে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের চেষ্টা করছে।
১১ সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাঁজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও বর্তমানে সেই অবরোধ কিছুটা শিথিল হয়েছে।
গাজায় ওই ত্রাণ বিতরণের ভিডিওগুলোকে হৃদয় বিদারক বলে মন্তব্য করে জাতিসংঘ বলছে, তারা ইতোমধ্যে ২১ লাখ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের একটি পরিকল্পনাও তৈরি করে রেখেছে।
জাতিসংঘসহ অন্যান্য খাদ্য সংস্থা জিএইচএফ’র এই কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা বলছে, এই উদ্যোগ মানবিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে এবং ত্রাণকে রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে।
তারা সতর্ক করে বলেছে, এই ত্রাণ কার্যক্রম শারীরিকভাবে দুর্বলদের পিছে ঠেলে দেবে এবং সাথে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে, বিপদের মুখে ফেলবে এবং বৈশ্বিকভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য একটি খারাপ নজির তৈরি করবে।
ইসরায়েল অবশ্য বলছে, হামাস যাতে ত্রাণ চুরি না করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতেই বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। যদিও ইসরায়েলের এই চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেছে হামাস।
এর আগে সোমবার জিএইচএফ ঘোষণা দেয় যে, তারা গাজায় কার্যক্রম শুরু করেছে এবং বিতরণ কেন্দ্রগুলো থেকে ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ দিচ্ছে তারা।
মঙ্গলবার বিকেলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, রাফাহর তাল আল-সুলতান এলাকায় এবং মোরাগ করিডোরে দুইটি বিতরণ কেন্দ্র থেকে খাদ্য বিতরণ শুরু হয়েছে।
প্রায় একই সময়ে, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমে তাল আল-সুলতান কেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সারির শেয়ার করে।
কিন্তু এর এক ঘণ্টা পরই দেখা যায়, হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুরা কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়েছে। এক ভিডিওতে লোকজনকে দৌড়াতে ও নিচু হয়ে পড়তে দেখা যায়, পেছনে গুলির শব্দ শোনা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লোকজন বিতরণ এলাকা থেকে খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ লুটপাট করে নিচ্ছিল। তাদের ভাষ্যমতে, আশপাশে অবস্থান নেওয়া ইসরায়েলি সেনারাও গুলি ছুড়েছে।
বিবিসি আরবিকে সেখানকার এক ব্যক্তি বলেন, ‘অবস্থা খুবই কঠিন ছিল। প্রতি দফায় মাত্র ৫০ জনকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল। শেষে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখন মানুষ গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে, অন্যদের মারধর করে এবং সব ত্রাণ নিয়ে যায়।’
জিএইচএফ জানিয়েছে, তারা স্থানীয় এনজিওর সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত আট হাজার খাদ্যের প্যাকেট বিতরণ করেছে। যা দিয়ে প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার মানুষ খেতে পারবে। তবে জিএইচএফ তাদের এই কার্যক্রমে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেছে হামাসের বিরুদ্ধে। যদিও তারা এই দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
জিএইচএফ এক বিবৃতিতে বলেছে যে, শেষ বিকেলের দিকে এক সময় ত্রাণ প্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়লে তাদের দলটি কিছুটা পিছু হটে যাতে সবাই নিরাপদে ত্রাণ নিতে পারে এবং হতাহত এড়ানো যায়। কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক কার্যক্রম আবার শুরু হয় বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে, তারা কমাউন্ডের বাইরে সতর্কতামূলক ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে।
গাজায় হামাস পরিচালিত মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণ উদ্যোগ ‘ব্যর্থ হয়েছে’।
নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, ‘আমরা গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন কর্তৃক স্থাপিত একটি বিতরণ কেন্দ্রের আশেপাশে গাজা থেকে বেরিয়ে আসা ভিডিওটি দেখছি। সত্যি বলতে, এই ভিডিওগুলি, এই ছবিগুলি হৃদয়বিদারক।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জাতিসংঘের সমালোচনাকে ‘চরম ভণ্ডামি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তবে তিনি এটিও বলেছেন, আমার মনে হয়, অধিকাংশ মানুষ একমত হবেন যে এটা ইতিবাচক খবর। মূল কথা হচ্ছে গাজায় ত্রাণ যাচ্ছে।
জিএইচএফ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র খুলবে তারা। যেখানে ফিলিস্তিনিরা খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারবে। তারা জানিয়েছে, এই সপ্তাহের শেষ নাগাদ তারা ১০ লাখ মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিতে চায়।
মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে চারপাশে পাহারা দেবে ইসরায়েলি সেনারা। ফিলিস্তিনিদের সেখানে প্রবেশের আগে পরিচয় যাচাই ও হামাস সম্পৃক্ততা যাচাই করা হবে।
তবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো বলেছে, তারা এমন কোনো পরিকল্পনায় অংশ নেবে না- যা মানবতা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার মৌলিক নীতিগুলোকে লঙ্ঘন করে।
ইসরায়েল গত দোসরা মার্চ গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। দুই সপ্তাহ পর সামরিক অভিযান শুরু করে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে। তাদের লক্ষ্য ছিল গাজায় জিম্মি থাকা ৫৮ জনকে মুক্ত করা।
সূত্র : বিবিসি।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ