এবারের বর্ষায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে পদ্মার শাখা নদী বড়াল। দীর্ঘ একচল্লিশ বছর পর চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে থাকা স্লুুইসগেটের তিনটি কপাট অপসারণ করায় পদ্মার পানি কোনো রকম বাধা ছাড়াই বড়ালে প্রবেশ করেছে। এতে নদীটি তার হারানো প্রাণ কিছুটা ফিরে পেয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু স্লুুইসগেট সরালেই সমস্যার সমাধান হবে না। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ ধরে রাখতে হলে আরও অনেক উদ্যোগ প্রয়োজন।
তাদের মতে, পদ্মা নদীতেই যেখানে শুস্ক মৌসুমে পানি থাকেনা, সেখানে বড়াল নদীতে পানি আসবে কোথা থেকে। তদুপরি, বড়ালের গভীরতা নেই বললেই চলে। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এজন্য খনন প্রয়োজন। আর এই খনন কাজ চালিয়ে যেতে হবে বড়ালের উৎসমুখ থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার পর্যন্ত। তাহলে হয়তো শুষ্ক মৌসুমে কিছুটা পানি থাকতে পারে।
এ ব্যপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবো’র সাবেক এক মহাপরিচালক জানান, পদ্মা নদীর পানি ১০ মিটার আরএল (রিডিউস লেভেল) এর নিচে নেমে গেলেই বড়াল নদীতে আর পদ্মার পানি প্রবেশ করেনা। অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত পদ্মা নদী যেখানে পানি শূণ্যতায় ধূঁকে, সেখানে বড়াল নদী পানি পাবে কিভাবে? এছাড়াও শুস্ক মৌসুমে বড়ালের উৎসমুখ থেকে পদ্মা নদী অনেক দূরে সরে যায়। ওই সময়টায় বড়ালের উৎসমুখের সামনে বিশাল চর জেগে উঠে।
বড়াল নদীতে পানি কেন থাকেনা?
বড়াল নদীতে পানি না থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে- শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়া। মূলত গঙ্গা নদীতে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণেই শুস্ক মৌসুমে পদ্মা নদী শুকিয়ে ধূঁধূঁ বালুচরে পরিণত হয়। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে ভারতের সাথে ত্রিশ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি থাকলেও সে মোতাবেক পানি বাংলাদেশকে দেওয়া হয়না। শুষ্ক মৌসুমে যেখানে কমপক্ষে ৩০ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা, সেখানে বাংলাদেশের সর্বনি¤œ পানি প্রাপ্তির রেকর্ড ১৫ হাজার ৬০৬ কিউসেক।
পানি কম পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে-ফারাক্কা বাঁধের উজানে অন্তত ৪০০টি পয়েন্ট থেকে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেয়। এরমধ্যে আপার গঙ্গা ক্যানেল, মধ্য গঙ্গা ক্যানেল ও নি¤œ গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট তিনটি হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ভারতের এই পানি প্রত্যাহারের কারণে এখানকার পরিবেশ, কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও আর্থ-সামাজিত অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পদ্মার শাখা বড়াল নদীর উপরও।
এছাড়াও অপরিকল্পিত খনন, দখল ও দূষণের কারণেও বড়াল নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং এর উৎসমুখে পলি জমে নদীর মরণদশা হয়। যার কারণেই চারঘাটে নির্মিত স্লুইসগেটটি অপসারণ করা হয়। যদিও স্থানীয়দের অনেকের মতে, এই গেট না সরালেও বর্ষায় পানির প্রবাহ এমনই থাকতো।
চারঘাট স্লুইসগেটের সামনের ছবি।
বড়াল নদীতে পানি না থাকার আরও কারণ হচ্ছে- এই নদীর উপর অপরিকল্পিতভাবে তিনটি ¯ুøইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। রাজশাহীতে চারঘাটে নির্মিত স্লুইসগেটটি পদ্মার উসমুখ থেকে ১২শ’ মিটার দূরে। এরপর নাটোরের আটঘরিয়ায় ১৯৯৫-৯৬ সালে পাঁচ দরজার একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। পাবনার চাটমোহরেও এই নদীর উপর একাধিক আড়াআড়ি বাঁধ (ক্রসবাঁধ) এবং একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্লুইসগেট এবং বাঁধের কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে নদীটি এখন মরাখালে পরিণত হয়েছে।
বরাল নদীর গুরুত্ব
কারো মতে বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ১৪৭ কিলোমিটার। আবার কেউবা বলছেন এটির দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ি, পদ্মার উৎসমুখ থেকে উৎপন্ন বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার। রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বাঘাবাড়ী হয়ে এটি হুড়া সাগরে মিশে নাকালিয়া নামক স্থানে যমুনা নদীতে পড়েছে। আবার কারো মতে, এই নদী রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনায় পতিত হয়েছে।
একসময় বড়াল নদীকে ঘিরে দুপারের মানুষের স্বপ্ন ছিল। নদীতে মাছ ছিল, নদীর পানি সেচ কাজে ব্যবহার করে অধিক ফসল ফলাতো। এখন সেই স্বপ্ন ফিঁকে। নদীতে পানি না থাকায় এখানকার কৃষি, সেচ ও মৎস উৎপাদনে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রভাব। এই নদীর প্রাণ ফিরাতে এলাকাবাসী বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছে। কখনো নদী খনন করে নব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য, আবার কখনোবা নদী খেকোদের উচ্ছেদের জন্য।
শুষ্ক মৌসুমে স্লুইসগেটের কপাটসহ ছবি-সংগৃহিত
এক সময় যোগাযোগের সুবিধার কারণে বড়াল নদীর দুই পাড়ে জামনগর বাজার, তমালতলা বাজার, বাগাতিপাড়া থানা ভবন, দয়ারামপুর সেনানিবাসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে ওঠে। বছর জুড়েই এই নদীতে নৌকা চলাচল করতো। এখন বছরের ৮ থেকে ৯ মাস পানি থাকেনা। এক কালের খর¯্রােতা নদী বড়াল শুকিয়ে তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। নদীটির নাব্যতা হারিয়ে এখন কৃষকের ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে ধান, গম, মশুরসহ বিভিন্ন ফসলের জন্য হালচাষ করা হচ্ছে।
এরই আলোকে বড়াল নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা বিজওয়ানা হাসান চলতি বছর ১৯ মে রাজশাহীর চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখ পরিদর্শনে যান। তিনি পদ্মা নদী ধেকে প্রায় ১২শ’ মিটার দূরে বড়াল নদীতে দেওয়া স্লুইসগেটের তিনটি কপাট অপসারণের নির্দেশ দেন। ওইসময় পানি সম্পদ উপদেষ্টা আরও বলেন, বড়ালের উৎসমুখে চারঘাট স্লুুুইসগেটটি সরিয়ে ফেললেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে-এটা ঠিক নয়। বড়ালে পানির প্রবাহ আসবে কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনার পাশাপাশি বড়াল নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগিদের কথা
সাখাওয়াত হোসেন সুজন (৫০) মিয়াপুর চারঘাট পৌরসভার বাসিন্দা। তার মতে, এক সময় এই নদী পানিতে ভরা থাকতো। মাছ ধরতে নামতাম। গরু-মহিষ গোসল করাতাম। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এখন মাছ নেই। এখানকার জেলে সম্প্রদায় তাদের পেশা বদল করেছে। তিনি বলেন, চারঘাট স্লুইসগেটটি খুলে দেওয়ায় পানির প্রবাহ বেড়েছে। তবে নদী খনন এবং দখলমুক্ত না করলে এর সুফল আসবেনা।
সারদা থানা পাড়ার মো: জাকির হোসেন বলেন, স্লুইসগেটের কপাট খুলে দেওয়ায় পানির প্রবাহ বেড়েছে। কিন্ত চারঘাট ব্রীজের কারণে পানি টানতে পারছে না। গত বছরের তুলনায় এবার পানির প্রবাহ বেড়েছে।
চারঘাটের মুজিবুর রহমান (৬০) জানান, এই নদী খনন করে আরও চওড়া ও গভীর করতে হবে। একইসাথে দয়ারামপুর ব্রীজের গেট খুলে দিতে হবে। তার মতে, চারঘাট নাউপাড়া, ফকিরপাড়া, চারঘাট থানাপাড়া, মিয়াপুর, উনপমপুর, শিকড়া, পাটিয়াকান্দি, পুটিমারি, কালোহাটি, আড়ানি হয়ে দয়ারামপুর ব্রীজের কাছে যেয়ে নদী মরে গেছে। নদীর পানি প্রবাহ বাড়াতে হলে সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) রাজশাহী জেলা কমিটি সভাপতি ও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জামাত খান জানান, চারঘাটে অবস্থিত স্ল্ুইসগেটটি ১৯৮৪ সালে বন্যা থেকে স্থানীয়দের সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই বাধা দূর করতে হলে কেবল খননই যথেষ্ট নয়, দয়ারামপুরসহ অন্যান্য স্থানে দেওয়া বাঁধ ও স্লুইসগেটগুলো অপসারণ করতে হবে। এছাড়াও বড়াল নদীর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণেরও অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষ্য
এ ব্যপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহী জোনের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ মোখলেসুর রহমান বলেন, বড়াল নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। যার মধ্যে নদী খনন থেকে শুরু করে উচ্ছেদ অভিযান সবই থাকবে। পানি সম্পদ উপদেষ্টা আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন- আমরা সেভাবেই কাজ করছি।
আর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী জানান, চারঘাট স্লুইসগেটের কপাট সরিয়ে নেওয়ায় বড়াল নদীতে পর্যাপ্ত পানি আসছে। আসা করি, শুষ্ক মৌসুমে নদী খনন ও উচ্ছেদ কাজ শুরু করতে পারবো। এজন্য ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি