বাংলা৭১নিউজ, চট্টগ্রাম: পা গুলো ড্রেসিং রুমের পথে বাড়ছিল না, যেতে চাচ্ছিলও না। মুখ ভর্তি হতাশা আর ক্লান্ত শরীরে মুশফিকুর রহিম হতাশায় নিমজ্জিত। ২৩৯ মিনিট ক্রিজে থেকে পেসার লাকমালের বলে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ৯২ রান করে আউট হওয়া কতটা কষ্টকর তা মুশফিককে দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। মাত্র ৩১ মিনিট, তাহলেই ষষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ আর দিন শেষে নিশ্চিন্তে এক ঘুম দেয়া যেত। কিন্তু মাত্র ৮ রানের আক্ষেপ মুশফিক ভুলবেন কি করে?
তবে মুশফিকের আউট হওয়ার দৃশ্য চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিনে পুরো বাংলাদেশের চিত্র নয়। পুরো বাংলাদেশের চিত্র আরও সুখকর। তবে ওই সুখী পরিবারে দুঃখ রয়ে গেল একমাত্র মুশফিকেরই। তবে মুমিনুল হককে নিয়ে মুশফিক বাংলাদেশকে যেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাতে দুঃখ খানিকটা হলেও কমে যাওয়ার কথা।
তৃতীয় উইকেটে তাদের রেকর্ড গড়া ২৩৬ রানের জুটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশের পুঁজি ৪ উইকেটে ৩৭৪ রান। এর আগে টেস্টের প্রথম দিনে এতো রান করেনি বাংলাদেশ। ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খুলনার করেছিল ৩৬৫ রান।
১৯২ বলে ১০ বাউন্ডারিতে ৯২ রানের ইনিংস খেলে মুশফিক পার্শ্বনায়কের ভূমিকায় থাকলেও আজকের মূল নায়ক মুমিনুল হক।যদি বলা হয় সব আলো মুমিনুল কেড়ে নিয়েছেন তাহলেও ভুল হবে না। দলীয় ৭২ রানে তামিমের (৫২) বিদায়ের পর তিনে নেমে পুরো মাঠ মাতিয়ে রাখেন মুমিনুল। নিজ শহরের মাঠে প্রতিপক্ষ বোলারদের উপর চড়াও হয়ে খেলে রানের ফুলঝুরি ছোটান। ৫৯ বলে ৭ বাউন্ডারিতে চোখের পলকেই পৌঁছে যান পঞ্চাশে।
চট্টগ্রামে এর আগে যতবার পঞ্চাশ করেছেন মুমিমুল ঠিক ততবারই তিন অঙ্ক ছুঁয়েছেন। আজও তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ৯৬ বলে পৌঁছে যান তিন অঙ্কে যা বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় দ্রুততম। চা-বিরতির আগে পঞ্চম টেস্ট সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পর বিরতির থেকে ফিরে ব্যাটিংয়ে আগ্রাসন দেখান ২২ গজের ক্রিজে। কিন্তু দিনের শেষ ত্রিশ মিনিটে মুশফিকুর রহিম ও লিটন কুমার দাশের আউটে কিছুক্ষণ থমকে যায় তার ব্যাট। ২০৩ বলে ১৬ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ১৭৫ রানে যখন দিন শেষে ড্রেসিং রুমে ফিরেন তখন তার চোখে রাজ্যের সুখ, মুখে চড়া হাসি আর বড় অর্জনের দীপ্তি। সাথে মাহমুদউল্লাহ ৯ রানে।
মুমিনুল কেন হাসবেন না, কেনই বা সেঞ্চুরির পর শ্রীলঙ্কার ড্রেসিং রুমের দিকে তাকিয়ে সেঞ্চুরির উদযাপন করবেন না! আজকের সেঞ্চুরির আগে আরও চারটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন মুমিনুল। কিন্তু কোনোটিতেই উদযাপন করেননি। কিন্তু আজ লাকশান সান্দাকানের বল বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে লঙ্কান ড্রেসিং রুমের দিকে তাকিয়ে মুমিনুল।পরক্ষণেই বাঁহাত মুষ্টিবদ্ধ করে শূন্যে ঘুষি ছুড়লেন। হেলমেট খুলে চোখে-মুখের তেজ দেখালেন। এক হাতে ব্যাট, আরেক হাতে হেলমেট। ব্যাট দিয়ে প্যাডে করলেন আঘাত। ড্রেসিংরুমে থাকা সতীর্থ এবং মাঠে উপস্থিত হওয়া দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিয়ে মুশফিককে ধরলেন জড়িয়ে বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে এমন উদযাপনের যে এক বার্তা আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই বার্তা দিন শেষের হাসি।
বার্তাটা প্রতিপক্ষ দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রতি! ‘অফ স্টাম্পের বাইরের বলে সমস্যা’, ‘শর্ট বলে সমস্যা’; এ দুই ‘দোষে’ নিজের পছন্দের তালিকা থেকে মুমিনুল হককে ফেলে দিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। সেই হাথুরুসিংহের দলের বিপক্ষেই আজ সেঞ্চুরি করেছেন মুমিনুল। হাথুরুসিংহে থাকা অবস্থায় যার একটি মাত্র সেঞ্চুরি, সেই মুমিনুল তার চলে যাওয়ার পরের ইনিংসেই করলেন সেঞ্চুরি।
মুমিনুলের ব্যাটিং টেকনিক, আগ্রসন, ধৈর্য্য সবকিছুতেই ছিল আভিজাত্যের ছাপ। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল হাথুরুসিংহে থাকার সময়েও ছিল না কোনো সমস্যা। শুধু সময়টাই খারাপ গিয়েছিল। তার যাওয়ার পরপরই শুরু হলো সুসময়। আর প্রথম ধাপেই দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি, দ্রুততম দুই হাজার রানের কীর্তি, তৃতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি।
রেকর্ড রানের জুটি গড়া মুশফিকুর রহিমও ছিলেন দুর্দান্ত। অধিনায়কত্ব ও উইকেটের পিছনের দায়িত্বে না থাকায় নির্ভার ছিলেন মুশফিক। তাতেই দলের সেরা তারকার মহাতারকা হয়ে উঠা। আজ ৯২ রানে থামলেও বড় কিছুর ইঙ্গিত মুশফিক দিয়ে গেছেন। তবে হতাশ করেছেন লিটন। প্রথম বল ছাড়তে গিয়ে হয়েছেন বোল্ড।
কিন্তু ওই মুমিনুল হক সৌরভের সুবাস ছড়ানো দিনে চোখের আড়াল হয়ে যায় সব কিছু। দ্বিতীয় দিনে তার প্রথম ডাবলের অপেক্ষা।
বাংলা৭১নিউজ/সিএইস