বাংলা৭১নিউজ,নাটোর প্রতিনিধি: সারাদেশে প্রসিদ্ধ নাটোরের সুস্বাদু লিচু। এই লিচু ফুলকে কেন্দ্র করে মৌমাছির জনপদে পরিণত হয়েছে এই এলাকা। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখর এই জনপদে আহরিত হচ্ছে টনকে টন মধু।
জেলার সকল উপজেলাতে লিচু চাষাবাদ হলেও গুরুদাসপুরের নাজিরপুর এবং বাগাতিপাড়া উপজেলার তমালতলার লিচু প্রসিদ্ধ। এরমধ্যে গুরুদাসপুরের নাজিরপুর এলাকার লিচু বাগানে মৌচাষ যেন একে অপরের পরিপূরক।
পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত লিচু বাগানগুলো এই এলাকার ঐতিহ্য। লিচুর বাগান জুড়ে স্থাপিত হয়েছে হাজারো মৌ বাক্স। এসব মৌ বাক্সে কোটি কোটি মৌমাছির গুঞ্জনে সৃষ্টি হয়েছে মধুময় পরিবেশ। আহরিত হচ্ছে কয়েক টন মধু-যা গুনে-মানে অতুলনীয়।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচু আবাদ হয়েছে। আবাদী জমির লিচু বাগানে আট হাজার মৌ বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটা মৌ বাক্সের ১০টি ফ্রেমে লক্ষ মৌমাছির উপস্থিতি। প্রত্যেক বাক্স থেকে দু’বারে অন্তত সাত কেজি করে মধু আহরিত হয়েছে। তৃতীয় বা শেষ বারের জন্যে মধু সংগ্রহে বর্তমানে মৌ চাষীরা অপেক্ষা করছেন। সব মিলিয়ে উৎপাদিত মধুর পরিমান হবে অন্তত পৌনে একশ’ টন।
মধু আহরণে নিয়োজিত প্রায় একশ’ মৌ চাষীদের মধ্যে বেশীর ভাগই এসেছেন নাটোরের বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। সাতক্ষীরা থেকে আসা মৌ চাষী দিলিপ মন্ডল গুরুদাসপুরের নাড়িবাড়ী এলাকার লিচু বাগানে ৬২টি মৌ বাক্সে মধু আহরণ করছেন।
বেশীর ভাগ মৌ চাষী বাইরে থেকে আসার কারন সম্পর্কে তিনি জানান, নাটোরের মধুর গুনগত মান বা গ্রেড ভালো বলে মৌ চাষীরা নাটোরে আসেন। নাজিরপুরের বেড়গঙ্গা রামপুর এলাকায় সোলায়মান হোসেনের লিচু বাগানে গাছের সংখ্যা ৭০টি। এই বাগানে ৬২টি মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন ক্ষিতিশ বিশ্বাস। সখের বশে মৌ চাষ করতে গিয়ে এখন অনেকটা পেশায় পরিণত হয়েছে, গড়ে তুলেছেন বিশ্বাস মৌ খামার।
মৌ বাক্স থেকে দুই বার মধু আহরণ শেষে তৃতীয় বার আহরণে অপেক্ষায় থাকা ক্ষিতিশ বিশ্বাস বলেন, মৌ বাক্স নিয়ে অল্প দিন পরেই দিনাজপুরে যাবো। ঐখানে লিচু ফুলের আগমন একটু দেরীতে।
মোল্লাবাজারে ১১৬টি মৌ বাক্স থেকে এ পর্যন্ত ১১ মণ মধু পেয়েছেন আলহাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, কার্ত্তিক-অগ্রহায়ন মাসে সরিষা ফুলের মধু, ফাল্গুনে লিচুর মধু এবং এরপর শুরু হবে কালোজিরা ও তিলের মধু আহরণ। বাক্স থেকে মধু আহরণে সাত-আটদিন সময় দিলে মধুর আর্দ্রতা কম হয়ে ভালো মানের মধু পাওয়া যায়।
নাজিরপুরের মামুদপুর মধ্যপাড়া এলাকার লিচু বাগানে ৪৪০টি লিচু বাক্স স্থাপনকারী মৌ চাষী রেদোয়ানুল ইসলাম জানান, চাষের মধু সম্পূর্ণভাবে হাতের স্পর্শ ছাড়া নিষ্কাশন করা হয় বলে পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত। মৌ চাষীদের পেশাগত সুবিধা তথা মধু সংগ্রহে লিচু বাগানে শৃংখলা বজায় রাখা, গুনগত মান নিশ্চিত করা ও বিপননের উদ্দেশ্যে নাজিরপুরের মোল্লাবাজার এলাকায় গঠন করা হয়েছে নাটোর জেলা মৌ চাষী সমবায় সমিতি লিমিটেড। নিবন্ধিত এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ৩১ জন।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলন সরকার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঝড়-বৃষ্টির কারনে আমাদের বেশ ক্ষতি হয়েছে। ইতোপূর্বে আমরা ভারতে মধু রপ্তানী করছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খারাপ মানের মধু সরবরাহ করায় আমরা ঐ বাজার হারিয়েছি। স্থানীয় বাজারে মধু ক্রয়কারী কোম্পানীগুলো সিন্ডিকেট গড়ে তোলায় বিপননের গতি শ্লথ। মধুর মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিলে আমরা উপকৃত হবো বলে জানান মিলন সরকার।
মৌ বাক্স স্থানান্তরের সময় পরিবহন চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় জানিয়ে সমিতির সভাপতি সুবল দাস তা বন্ধে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহনের দাবী জানান।
নাজিরপুর কৃষি ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আতাহার হোসেন এবং দুধগাড়ি ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ এনামুল হক বালেন, আমরা মৌ চাষীদের পাশে থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
বিসিক, নাটোরের ব্যবস্থাপক দিলরুবা দিপ্তি বলেন, বিসিক মৌ চাষীদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান করে সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল করিম বলেন, উপজেলার নাজিরপুরের লিচু ও মৌ চাষ এই এলাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। শুধু মধু উৎপাদনই নয়, রাণী মৌমাছিসহ মৌমাছির কেনাবেচা এই এলাকার লাভজনক ব্যবসায়। রয়েল জেলি, পোলেন গ্রেইন ও প্রোকোলিশ এর মত উপাদান সহায়ক পণ্য হিসেবে উৎপাদনে মৌ চাষীরা সক্ষম হলে তাদের মুনাফার পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগ ভূমিকা রাখতে পারে, আগ্রহী অন্য প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসতে পারেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ