বাংলা৭১নিউজ, ডেস্ক: ধর্ষক স্বামীকে হত্যার দায়ে সুদানি নারী নোরার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া৷ তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে৷ নোরার ফাঁসি হলে, তা হবে মানবাধিকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা৷
নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা তো বটেই, মানবিক জায়গা থেকেও নোরার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা করে তাঁকে খালাস করার দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেকে৷
নোরা হোসেইন হামাদের বয়স ১৯ বছর৷ মে মাসের ১৭ তারিখ সুদানের আদালতে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই মাত্র ১৬ বছর বয়সে নোরার বাবা জোর করে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন আবদুলরাহমান হামাদ নামের এক ব্যক্তির সাথে৷
জানা যায়, দু’বার বিয়ে পড়ানো হয়েছিল তাঁর৷ প্রথমে নোরার বাবা ও স্বামীর মধ্যে একটি চুক্তির হয়৷ পরে আবারো বিয়ে পড়ানো হয় তাঁকে৷ এরপর ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে স্বামীর বাড়িতে পাঠানো হয় নোরাকে৷ কিন্তু নোরা স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কে জড়াতে অস্বীকৃতি জানায়৷ মে মাসের ২ তারিখে স্বামী আবদুলরাহমান হামাদ নিজের দুই ভাই এবং এক চাচাত ভাইয়ের সহায়তা নিয়ে তাদের সামনেই নোরাকে ধর্ষণ করে৷
পরদিন সকালে নোরাকে আবারো তাঁর স্বামী ধর্ষণ করতে গেলে সে ঘর থেকে পালিয়ে রান্নাঘরে যায়৷ এ সময় হাতের কাছে হঠাৎই একটা ছুরি পেয়ে যায় নোরা৷ ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আবদুলরাহমান হামাদ তাঁর হাতের ছোরার আঘাতে গুরুতর জখম হয় এবং পরে মারা যায়৷
শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে বাবার বাড়িতে গেলেও, নিজের বাবাই নোরাকে পুলিশ দেন৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য সংগঠনের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নোরার বিচার কাজ চলার সময় এই হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত খুন’ বলে বর্ণনা করেছে আদালত৷ কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় নোরাকে যে বিয়ের পর ধর্ষণ করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো কথাই সেখানে হয়নি৷
সুদানে এ ধরনের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তৈরি হলেও, এখনও তা ততটা জোরালো নয়৷ দেশটির আইন ১০ বছর হলেই মেয়েদের বিয়ের অনুমোদন দেয়৷ তবে একমাত্র আদালতের একজন বিচারকের সামনে এবং কন্যার অভিভাবকের উপস্থিতিতে এ বিয়ে হওয়ার বিধান আছে৷ জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, সুদানি মেয়েদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে৷
এদিকে আফ্রিকা ইউথ মুভমেন্টের কর্মী বদর আলদিন সালাহ বলেন, ‘‘সুদানে চালু মুসলিম শরীয়া আইন অনুযায়ী, নোরার মতো ঘটনায় তাঁর স্বামীর পরিবার অর্থের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ নিতে পারতো কিংবা ফাঁসি চাইতে পারত৷ নোরার শ্বশুরবাড়ির পরিবার তার ফাঁসি চেয়েছে৷”
নোরার আইনজীবী জানান, এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে আপিল করতে চান তাঁরা৷ কিন্তু এর জন্য শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন৷ যেমন আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপ৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় অবশ্য নোরার শাস্তি মাফের সপক্ষে প্রচারণা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই৷চেঞ্জ ডট ওআরজি এবং আভাজ ডট কমের মতো প্রতিষ্ঠান নোরার মুক্তির পক্ষে স্বাক্ষর করতে প্রচারণায় জোর দিচ্ছে৷
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন, যেমন ‘ইকুয়ালিটি নাও’ বলছে যে, তারা সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে নোরার শাস্তি মওকুফের জন্য ‘ক্ষমাপ্রার্থনার’ চিঠি লিখবে, যাতে উল্লেখ থাকবে নোরার এ মৃত্যুদণ্ডাদেশ সুদানি সংবিধান পরিপন্থি৷
‘ইকুয়ালিটি নাও গ্লোবাল’-এর পরিচালক ইয়াসমিন হাসান বলেন, ‘‘নোরা পরিস্থিতির শিকার৷ সে কোনো অপরাধী নয়৷ বিষয়টা এভাবেই দেখা উচিত৷ নোরার মতো এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার নারীদের অনেক দেশেই পালটা সেবা দেওয়া হয়, যাতে তারা দুঃসহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে৷”
ইয়াসমিন হাসানের কথায়, ‘‘নিজেকে রক্ষার জায়গা থেকে নোরাকে অপরাধী বানিয়ে ফেলা অন্যায়৷ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হবে৷ এটা সুদানের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি৷”
নোরার ঘটনায় প্রতিদিনই প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন নিজ নিজ অবস্থানের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা৷ টুইটারে #justicefornoura প্রচারণায় অংশ নিয়ে মতামত জানাচ্ছেন তাঁরা৷
সুদানের ঔপন্যাসিক হামোর জায়েদা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘নোরা পরিস্থিতির শিকার, অপরাধী নয়৷ তাই তাকে বাঁচাতে আমাদের এক জোট হওয়া উচিত৷”
‘‘আমাদের সবার নোরাকে বাঁচাতে এবং বিয়ের পর ধর্ষণ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত”, ফেসবুকে লিখেছেন নারী অধিকারকর্মী আমাল হাব্বানি৷
ব্রিটিশ সুপার মডেল নওমি ক্যাম্পবেল লিখেছেন, ‘‘আমি নাওমি ক্যাম্পবেল৷ আমি সুদানের সরকারের কাছে নোরার জন্য ক্ষমার আবেদন জানাচ্ছি এবং তাদের বলছি এটা প্রমাণ করতে যে যারা ধর্ষণের শিকার হয়, তারাই প্রকৃত ভুক্তভোগী৷”
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার নোরার শাস্তি মওকুফ চেয়ে আবেদনের শেষ দিন ছিল৷ সেইদিন শেষ মুহূর্তে তাঁর আইনজীবীরা সুদান সরকারের কাছে ক্ষমার আবেদন জানিয়েছেন৷
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা এরই মধ্যে নোরার ক্ষমার আবেদন বিবেচনায় নিতে সুদান সরকারকে অনুরোধ করেছে৷ উল্লেখ্য, জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতার সূচকে ১৮৮টি দেশের মধ্যে সুদানের অবস্থান ১৬৫৷
এখন দেখার বিষয় অত্যাচারের শিকার এই নারী পুরুষতান্ত্রিকতার বলি হন কিনা!
বাংলা৭১নিউজ/তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে/ ডিপিএ, এএফপি, এপি/এসএইচ