টিনা আক্তার ও বিথি, দু’জনই বাংলাদেশি তরুণী। উন্নতজীবনের আশায় ঢাকা ছেড়ে সিঙ্গাপুর পাড়ি দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু সেখানে ফেঁসে যান তারা। তাদেরকে বাধ্য করা হয় পতিতাবৃত্তিতে। অবশেষে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে সিঙ্গাপুরের আদালতে জয়ী হয়েছেন ওই দুই তরুণী। খবর স্ট্রেইট টাইমস’র।
যদিও প্রতিবেদনে তাদের নাম ছাড়া বিস্তারিত ঠিকানা প্রকাশ করা হয়নি। তবে তাদের দীর্ঘসংগ্রাম এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতের বর্ণনা ওঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
জানা গেছে, তাদের বয়স তখন ২০-এর কোটায়। ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে বিথি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। আর টিনা দেশটিতে পৌঁছান ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। গৃহস্থালি কাজের কথা বলে নেওয়া হয়েছিল তাদের। ‘স্বদেশি’দালাল রকির মাধ্যমে তারা সেখানে যায়। নানা অপকর্মে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নিশ্চিত জেল-জরিমানার মুখে পড়তে যাওয়া রকি গ্রেফতার এড়াতে কৌশলে সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে যায় বছর খানেক আগে। তার অবস্থান কোথায় তা এখন অজানা। অবশ্য রকিকে পালাতে সহায়তাকারীকে জেল খাটতে হচ্ছে।
সিঙ্গাপুর পৌঁছার পর টিনা ও বিথির আশ্রয় হয় কলিউড ডান্স লাউঞ্জ নামে একটি ক্লাবে। ডান্সার হিসেবে কিছু দিন তারা কাজও করেন। নৃত্য করে কাস্টমারদের আনন্দ দেওয়ার কাজে বেশ মানিয়ে নিচ্ছিলেন ‘আনাড়ি’ ওই দুই বাংলাদেশি তরুণী। আয় রোজগারও হচ্ছিল কম-বেশি, যদিও চুক্তির তুলনায় তারা খুবই কম টাকা পাচ্ছিলেন। এতে তাদের মনোকষ্ট ছিল, কিন্তু ছেড়ে আসার উপায় ছিল না। ফলে তারা ক্লাবের ডান্সারের কাজে ছিলেন নিমরাজি।
ব্যত্যয় ঘটে যখন ক্লাব মালিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়তি মনোরঞ্জনের জন্য বিছানায় যাওয়ার প্রস্তাব আসে। ঘটনার দিনক্ষণ আলাদা হলেও দু’জনের জীবনের গল্প প্রায় অভিন্ন। জমে থাকা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় বিথি কু-প্রস্তাবে রাজি হলেও সোজা সাফটা ‘না’ বলে দেন টিনা। যদিও তাকে ডলারের বান্ডিল দেখিয়ে যৌনকর্মে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছিল। তাতেও সম্মতি না দেওয়ায় রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন অত্যাচারী মালিক। চড় মেরে বসেন টিনার গালে। ঘাড় চেপে ধরে প্রাণনাশের হুমকিও দেন। ‘সম্মতি’ দেওয়ায় বিথি শারীরিক নির্যাতন থেকে রেহাই পেলেও টিনার অসম্মতি রীতিমতো কাল হতে যাচ্ছিল। অবস্থা ছিল বেগতিক। পরিস্থিতি খানিক অনুকূলে আসার পর ক্লাব থেকে পালানোর পথ খোঁজেন দু’জনই। অবশ্য সেখানে আগে থেকে ডান্সার হিসেবে কাজ করা বিদেশি দুই তরুণী তাদের বেশ সাহায্য করেছিলেন।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে কোনও এক ভোরে ক্লাব কর্তৃপক্ষের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে পালাতে সক্ষম হন তারা। মুক্ত টিনা ও বিথি দুই ভিনদেশি সহকর্মীর (যারা সহায়তা করেছেন) পরামর্শে অভিযোগ নিয়ে সোজা চলে যান সিঙ্গাপুরের মিনিস্ট্রি অব ম্যানপাওয়ার (এমওএম)-এ । সেদিন থেকেই তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার যুদ্ধ শুরু। বিদেশি শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ নিরসনে সিঙ্গাপুর সরকারের ওই দফতর সক্রিয়ভাবে কাজ করে। অবশ্য শ্রমিকদের দিয়ে ভুয়া মামলা করিয়ে ফায়দা লুটার জন্য সেখানেও মধ্যসত্বভোগী কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গজিয়ে ওঠার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিথি ও টিনার কেস ছিল সাচ্চা, অকাট্য প্রমাণ ছিল তাদের হাতে। যা গত বুধবার (২৫ আগস্ট) ঘোষিত দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ফাইনাল রায়েও উল্লেখ রয়েছে।
দ্য স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশি দুই টিনেজের মামলায় যৌথ মালিকানাধীন ক্লাব কলিউড ডান্স লাউঞ্জে অনেককে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা এবং ভিকটিমদের ন্যায় বিচারপ্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দায়ে দুই মালিককে গত বছর (২০২০ সালে) দণ্ডাদেশ দেন সিঙ্গাপুরের (নিম্ন) আদালত। মালিকদ্বয় হলেন ষাটোর্ধ রাজেন্দ্র নাগারিথিনাম এবং ৪৬ বছর বয়সী আরুমাইকান্নু শশী কুমার। রাজেন্দ্র ৪টি অভিযোগে দণ্ডিত হন, আর শশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ৩টি। জেল, জরিমানা- উভয় দণ্ড হয় তাদের। কিন্তু নাছোড়বান্দা রাজেন্দ্র ও শশী উভয়ে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যা নিম্ন আদালতে প্রমাণ হয়েছে, সেটিসহ দণ্ডাদেশ চ্যালেঞ্জ করেন উচ্চ আদালতে। সিঙ্গাপুর সুপ্রিম কোর্ট তাদের আপিল আমলে নিয়ে দীর্ঘ শুনানি শেষে বুধবার চূড়ান্ত রায় দেন।
রায়ের কপি পর্যালোচনা করে স্ট্রেইট টাইমস এর ল’ রিপোর্টার সেলিনা লুম লিখেন- উচ্চ আদালত প্রধান আসামি রাজেন্দ্র নাগারিথিনামের রায় রিভিউর আপিল আংশিক আমলে নেন এবং তাকে চার অভিযোগের একটি থেকে পুরোপুরি খালাস দেন। বাকি তিন অভিযোগের দু’টিতে নিম্ন আদালত প্রদেয় দণ্ড খানিকটা কমিয়ে আনেন।
রায় পর্যালোচনায় বলা হয়, আগে চার অভিযোগে তার মোট ৩০ মাস জেল এবং ৩০০০ সিঙ্গাপুর-ডলার জরিমানা দেওয়ার কথা ছিল। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের পর রাজেন্দ্রকে ১৯ মাস জেল খাটতে হবে আর কোনও ধরনের ওজর-আপত্তি ছাড়া আড়াই হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হবে। একই আদালত অপর আসামি আরুমাইকান্নু শশী কুমারের আপিল পুরোপুরি খারিজ করে দেন। নিম্ন আদালত প্রদত্ত দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। শশীকে ১৬ মাস কারাগারে এবং এক হাজার ডলার জরিমানা পরিশোধ করতে হবে।
সংবাদমাধ্যমে রাজেন্দ্রকে সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং শশীকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত (পিআর) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, বিথিকে জোর করে পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে যে অর্থ পাওয়া যেতো তার বড় অংশই পকেটস্থ করতেন রাজেন্দ্র ও শশী। তাছাড়া টিনাকে বলপূর্বক যৌন-শোষণের জন্য কিনতে চেয়েছিলেন শশী। তবে কমনলি দু’জনের জেল-জরিমানা হয়েছে তাদের অধীন কলিউডে কর্মরত (বাংলাদেশি দালাল) রকিকে সিঙ্গাপুর থেকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। যদিও (তারা উভয়ে) যৌনতার জন্য বাংলাদেশি ওই দুই তরুণীকে ‘ক্রয় করা’র দায় অস্বীকারের চেষ্টা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত করে গেছেন। বিশেষ করে, আদালত রাজেন্দ্র’র উত্থাপিত যুক্তিগুলো বিবেচনায় নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস টায় এই মামলার রায়ে লেখেন, পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে বাড়তি আয়ের আশায় টিনাকে কিনতে সব রকম চেষ্টাই করেছেন রাজেন্দ্র।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ