মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অপ্রত্যাশিত বাকবিতণ্ডা ঘিরে উত্তেজনার পারদ যেন থামছেই না। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতাদের মুখে মুখে চলছে একই প্রসঙ্গ ‘ট্রাম্প-জেলেনস্কি সম্পর্ক’। কেউ ট্রাম্পের পক্ষে। কেউ আবার জেলেনস্কির। দুই নেতাকে ঘিরে দুভাগ বিশ্ব।
এক মেরুতে ঘোর শঙ্কা, আরেক উঠানে আনন্দ। জেলেনস্কিকে আক্রমণের পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নীরব থাকলেও দেশটির রাজনীতিবিদরা বেশ উল্লসিত। চুপ থাকলেও পুতিনও যে খুশি নন তা নয়। কারণ ওভাল অফিসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির ওই মারমুখি বৈঠকে মূলত যুদ্ধ জয়ের চেয়েও বড় বিজয় পেয়েছেন পুতিনই- এমনটাই বলছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, শুক্রবার হোয়াইট হাউজে জেলেনস্কি এবং ট্রাম্পের মধ্যে নাটকীয় সংঘর্ষের পর রুশ কর্মকর্তারা ও মস্কোর গণমাধ্যমগুলো উল্লাসের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে রুম নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ওই ঘটনাকে ওভাল অফিসে জেলেনস্কির ওপর নির্মম তিরষ্কার হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘ট্রাম্প ওই জোকারের (জেলেনস্কি) মুখের ওপর সত্যিটা বলে দিয়েছেন, কিয়েভ সরকার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে খেলছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়।’
ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধ করার আহ্বানও জানিয়েছেন মেদভেদেভ। সম্প্রতি পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের নেতারা ওয়াশিংটনে গিয়ে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থনের আহ্বান জানায়। এরপরই জেলেনস্কির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেন ট্রাম্প। এ নিয়ে মস্কোয় উদ্বেগ তৈরি হয়।
এ ছাড়া ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী ইউক্রেনে মোতায়েনের বিষয়ে ট্রাম্পের সদিচ্ছার ইঙ্গিত রাশিয়ায় উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সামনে জেলেনস্কির অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে সব দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে রাশিয়ার। যার প্রকাশ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া
জাখারোভা টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘ট্রাম্প আর ভ্যান্স কীভাবে ওই নোংরা লোকটাকে (জেলেনস্কি) ঘুসি মারা থেকে নিজেদের সংযত রাখলেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর।’
তবে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি পুতিন। দর্শকের মতোই পুরো ঘটনা নিবিড়ভাবেই পর্যবেক্ষণ করছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে ক্রেমলিন একটি সূত্র বলেছে, ‘পুতিন এই দৃশ্য বেশ উপভোগ করেছেন। সেই সঙ্গে ইউক্রেনে আরও চাপ দেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি। এই বৈঠক পুতিনের জন্য সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া যে কোনো বিজয়ের চেয়ে বড় জয়।’
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, পুতিন সম্ভবত শিগগিরই ট্রাম্পকে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করবেন, জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনার কোনো অর্থ নেই। তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। মস্কো এবং ওয়াশিংটন ইতিমধ্যেই এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করেছেন বলেও জানা গেছে। রুশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য আলেক্সেই পুশকভ টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘হোয়াইট হাউজ এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নতুন প্রার্থী খুঁজতে আরও মনোযোগী হবে।’
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষক আন্তন গ্রিশানভ বলেছেন, ‘স্বল্পমেয়াদের এই হাস্যকর সংঘাত নিঃসন্দেহে ইউক্রেনে জেলেনস্কির অবস্থান দুর্বল করে দেবে এবং রাশিয়ার ক‚টনৈতিক শক্তি বাড়াবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তবে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যেও এখনো শান্তিচুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে এবং ট্রাম্পের অনিশ্চিত স্বভাব যে কোনো সময় চমক সৃষ্টি করতে পারে।’
উল্লেখ্য, শুক্রবার ওভাল অফিসে ট্রাম্প-জেলেনস্কি আন্তরিকভাবেই শুরু করেন আলোচনা। কিন্তু প্রায় আধা ঘণ্টা পরেই পালটে যেতে থাকে দৃশ্যপট। বৈঠক চলতে চলতে হঠাৎই বাগ্যুদ্ধে জড়ান দুই নেতা। শুক্রবার ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ওই ঘটনা কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টার জন্য বড় ধাক্কা। এদিকে, ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া তার হামলা আরও তীব্র করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে লুকিয়ানভ সংক্ষেপে বলেছেন, ‘যুদ্ধ অব্যাহত।’
এই পরিস্থিতিতে জেলেনস্কিকে কতটা কাঠখড়া পোড়াতে হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপকেও ঝুঁকিতে ফেলছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের থেকে দূরে সরিয়ে রাশিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
মার্কিন কৌশলের তীব্র পরিবর্তন মহাদেশের নেতাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি একটি দুর্বল চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হয় তাহলে এটি রাশিয়াকে আরও সাহসী করে তুলবে। যা ইউরোপের বাকি অংশের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে উঠবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ