মুন্সীগঞ্জে খাবার আলুর সংকট দেখিয়ে হিমাগার থেকে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকায়। আর কয়েক হাত বদল হয়ে খুচরা বাজারে তা ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এবছর গত বছরের তুলনায় তিনগুণ দামে বীজ আলু কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। সারের দামও বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়েছে। অভিযানেও মিলছে না কোন সমাধান।
দেশের অন্যতম শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী জেলা মুন্সীগঞ্জ। রাজধানীর কাছের এ জেলায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে বীজ আলু। আমদানিকারকের কাছ থেকে ডিলারের হাত হয়ে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছতেই এ বীজের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এদিকে আবাদের উদ্দেশ্যে জমি প্রস্তত করছেন কৃষক।
গত বছর হল্যান্ডের বীজ আলুর প্রতি বাক্স বিক্রি হয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। সে বাক্স এবার কিনতে হচ্ছে তিনগুণ দামে ৩০ হাজার টাকায়। আর হিমাগারে সংরক্ষিত বীজ আলুর ৫০ কেজির বস্তা এবার দ্বিগুণ দামে পাঁচ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। সারের বস্তা প্রতি কিনতে খরচ বেড়েছে ১০০ টাকা। অন্যদিকে দাম নিয়ে ডিলাররা তথ্য গোপন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলু আবাদে নেমেছেন কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলার সক্রিয় ৫৮টি হিমাগারে এখনো ৩১ হাজার মেট্টিক টন খাবার আলুর মজুদ আছে। তবুও সংকট দেখিয়ে হিমাগার থেকে ৬৪ টাকায় আলু বিক্রি করছেন। যা খুচরা বাজারে ৮০ টাকা দেখে ভোক্তারা হতবাক।
ডিলারদের অজুহাত হচ্ছে ,এবার বাক্স বীজ আলুর সংকট রয়েছে। পাশাপাশি বিক্রয় রশিদে দাম কম দেখিয়ে কৃষকের কাছ থেকে নিচ্ছেন চড়া দাম। আবার কোনো ডিলার রশিদ ছাড়াও বাক্স বীজ আলু বিক্রি করছেন। আলু আবাদ মৌসুমের শুরুতেই বাক্স বীজ আলু বিক্রিতে ডিলারদের এমনই কারসাজির চিত্র উঠে এসেছে। এভাবেই ডিলারদের কারসাজিতে ১০ হাজার টাকার এক বাক্স বীজ আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০ হাজারে।
জানা গেছে, এ জেলার কৃষকদের বিএডিসি ও হিমাগারে সংরক্ষিত বীজ আলুর প্রতি আগ্রহ নেই। বছরের পর বছর ধরে এখানকার কৃষক বিদেশি, বিশেষ করে হল্যান্ডের বাক্স বীজ আলু আবাদ করে আসছেন। বরাবরের মতো এবারও আলু আবাদে বাক্স বীজের প্রতি কৃষকের বাড়তি ঝোঁক দেখা গেছে। আর এ সুযোগটিই নিচ্ছেন ডিলাররা।
ডিলারের কাছ থেকে বাক্স বীজ আলু কিনে বাড়ি ফিরছিলেন জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কৃষক আলমাস শেখ। এসময় কথা হলে ওই কৃষক জানান, টঙ্গীবাড়ি বাজারের মেসার্স মাহিন এন্টারপ্রাইজ থেকে হল্যান্ডের আটটি বাক্স বীজ আলু কিনেছেন। বাক্স প্রতি দাম পড়েছে ৩০ হাজার ৫০০ টাকা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আলমাস শেখ বলেন, “আমি মূর্খ মানুষ। লেখাপড়া করি নাই। রশিদে কত দাম লিখেছে, তা জানি না। আমি ৩০ হাজার টাকা দিয়েই একেক বাক্স বীজ আলু কিনেছি। এটাই সত্যি।”
তবে মেসার্স মাহিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী আলমগীর কবীর বিক্রয় রশিদে কম দাম উল্লেখ করার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আমি ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার করে বাক্স প্রতি বীজ আলু বিক্রি করছি।”
টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ধামারন গ্রামের আলু চাষি মামুন শেখ বলেন, “মূলত: আগামীতে বীজ সংরক্ষনের জন্য কৃষক হল্যান্ড থেকে আমদানি করা বাক্স বীজ আলু আবাদ করে থাকেন এ অঞ্চলের কৃষক। এ বছর বাক্স বীজ আলু আগাম বিক্রি হয়েছে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা করে। আর এখনতো দাম আরো অনেক বেড়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “বিএডিসির বীজ আলুর দাম কেজি প্রতি ৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্র্যাক ও কিষাণ সিডসহ কিছু কোম্পানির বীজ আলু বাজারে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।”
বীজ আলু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অরিত্র এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মো. রনি শেখ জানিয়েছেন, এ জেলায় ৪ থেকে ৫ জন বাক্স বীজ আলু আমদানি করে থাকে। টঙ্গীবাড়ি উপজেলার সোনারং গ্রামের এ আমদানিকারক বলেন, আমরা আলু আমদানির জন্য যখন এলসি করি, তখন অল্প পরিমাণ লাভে ডিলারদের কাছে বীজ আলু বিক্রি করে দেই। পরে অবশ্যই ডিলাররা কারসাজি করে দাম বাড়ান।
এ প্রসঙ্গে টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সম্প্রতি বীজ আলুর ডিলারদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে কৃষকের কাছে প্রতি বাক্স হল্যান্ডের বীজ আলু ১৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করার কথা জানিয়েছেন ডিলাররা। তারপরও যদি তারা বেশি মূল্যে বিক্রি করেন, সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. সামির হোসাইন সিয়াম বলেন, “জেলায় খুচরা পর্যায়ে কতজন ডিলার আছে, সেই তালিকা জানা নেই। আর এ জেলায় তিনটি আমদানিকারক এজেন্ট রয়েছে। এরমধ্যে এয়ার মালিক এজেন্টের আলু জেলায় এসেছে। বাকি দু’টি এজেন্টের আলু এখনো আসেনি। তাদের আমদানির হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে। আমাদের কাছে নেই।”
বীজ আলুর আকাশ ছোঁয়া দামের ব্যপারে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আসিফ আল আজাদ বলেন, “বীজ আলুতে সরকারের নির্ধারিত মূল্য না থাকায়, ডিলাররা ইচ্ছে মতো মূল্য হাকিয়ে বীজ আলু বিক্রি করছে।”
জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, মুন্সীগঞ্জ জেলায় খাবার ও বীজ আলুর কোন সংকট নেই। চলতি বছর এ জেলায় ৩৪ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বীজ আলুর চাহিদা রয়েছে ৭৬ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে জেলার ৫৮ টি হিমাগারে ৪৪ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু মজুদ রয়েছে।
তিনি বলেন, “গত বছরের তুলনায় এ বছর অর্ধেক বাক্স আলু আমদানি হয়েছে। তাই হয়তো দাম একটু বেশি। তবে আমরা প্রতিদিন বীজ আলুর দাম মনিটরিং করছি। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের টিম কাজ করছে।”
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ