সারা বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ ওমিক্রনে পর্যুদস্ত। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার ৩০% এর আশেপাশে। করোনা মহামারীর দুই বছরে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়। অনেক রোগীই তাদের নির্ধারিত চিকিৎসা পেতে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এই রকম কঠিন পরিস্থিতিতে ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ২০২২।
মূলত, মরণব্যাধি ক্যান্সার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে এবং এর প্রকোপ কমিয়ে আনার জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করা হয়।
বিশ্বে প্রথম এই দিবসটি পালন করা শুরু হয় ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে প্যারিসে। ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল (UICC) এর উদ্যোগে এই দিবসটি পালন করা হয়। দিনটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ক্যান্সার প্রতিরোধ ও ক্যান্সার রোগীদের জীবনধারার মান উন্নয়নে সহযোগিতা করে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯৬ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই রোগ সম্পর্কে সচেতন না হলে বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যা।
সবকিছু বিবেচনা করে এই বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে “Close the Care Gap”। এই প্রতিপাদ্যটি ২০২২-২০২৪ তিন বছরের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিপাদ্যটির বাংলা রূপ
১। ক্যান্সার চিকিৎসায় কি কি ঘাটতি আছে, সেগুলো নির্ণয় করা
২। ঘাটতিগুলো কমিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ নেয়া
৩। সর্বোপরি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের কষ্ট কমিয়ে আনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন (২০২০) অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী আছে। প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার এবং মারা যায় ১ লাখ ৯ হাজার মানুষ। জনসচেতনতার অভাবেই দেশে ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে।
যেসব কারণে ক্যান্সার হয় ঝুঁকিগুলোর মধ্যে ধূমপান, পান- জর্দা, তামাক পাতা খাওয়া, সবজি ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া, শারীরিক স্থূলতা, আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি, এক্স-রে রেডিয়েশন, কিছু রাসায়নিক পদার্থ, কিছু ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু অন্যতম। আমাদের দেশে পুরুষদের মধ্যে লাং ক্যান্সার ও মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার ও জরায়ু মুখের ক্যান্সার অন্যতম।
আশার কথা হচ্ছে, প্রাথমিক অবস্থায় এই মরণব্যাধিটি শনাক্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করে তোলা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে বাংলাদেশে ক্যান্সার ও এ রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও বেশ কিছু ঘাটতি বাংলাদেশে বিদ্যমান:
১। রোগীর তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে রাজধানীকেন্দ্রিক। যার ফলে সারা দেশের রোগীদের ঢাকায় আসতে হয়, যা কিনা চিকিৎসা সেবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
২। ক্যান্সার চিকিৎসায় পারদর্শী চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম
৩। ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের দামও বেশি
৪। ক্যান্সার চিকিৎসা ও প্রতিরোধে অতীব প্রয়োজনীয় ক্যান্সার ডাটাবেজ/ক্যান্সার রেজিস্ট্রিের অভাব
৫। ক্যান্সার চিকিৎসার প্রশমনে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু আমাদের দেশে এই সেবাটি এখনো প্রাথমিক অবস্থায় আছে।
বাংলাদেশের সরকার উপরিল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে ইতিমধ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিভাগীয় শহরগুলোতে ১০০ বেডের ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগক্তাদেরও বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল ঢাকার বাহিরে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।
সচেতন হতে হবে নিজেদেরই এবং কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। তবেই হয়তো ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হয়ে উঠবে। সুস্থ থাকি সকলে। আসুন বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ২০২২ এবারের প্রতিপাদ্য “Close the Care Gap” কে মাথায় রেখে আমরা প্রত্যেকে ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেষ্ট হই।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ডেপুটি ডিরেক্টর ,মেডিক্যাল সার্ভিসেস
এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ