বাংলা৭১নিউজ, এম.নাজিম উদ্দিন,পটুয়াখালী প্রতিনিধি: নানা ও নানির কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবকে। আজ বেলা সাড়ে ১১ টায় নানা বাড়ির উঠানে ৩য় দফা জানাজা শেষে রাজীবকে শেষ বিদায় দেয়া হয়। এর আগে সকাল ৯টায় বাউফল পাবলিক মাঠে রাজীবের ২য় জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ এমপি, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক ড. মাছুমুর রহমান, পুলিশ সুপার মোঃ মইনুল হাসান ও বাউফলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা রাজীবের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজীবের মরদেহ নিয়ে পটুয়াখালীর বাউফলে পৌঁছান স্বজনরা। ওইদিন দুপুরে জোহরের নামাজের পর হাইকোর্ট মসজিদে রাজীবের প্রথম জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। গভীর রাতে লাশ বহনকারী গাড়ি আসার পর রাজীবের বাড়িতে ভীড় করেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
এ সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। এদিকে, ছাত্র রাজীব হোসেনের পক্ষে ক্ষতিপূরণের মামলা হাইকোর্টে চালানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। তারা জানান, রাজীবের হাত হারানো অবস্থায় এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলাম এবং আদালত রুল দিয়েছিল। এখন যেহেতু রাজীব মারা গেছেন এজন্য ক্ষতিপূরণের জন্য টাকার পরিমাণ আরো বেশি চেয়ে সম্পূরক আবেদন করা হবে।
ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক সাংবাদিকদের বলেছেন, মাথায় আঘাতের ফলে রাজীবের মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়, এতেই তিনি মারা যান। সোমবার (১৬ এপ্রিল) দিবাগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি মারা যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক রাজীবের মৃত্যুর খবর তার স্বজনদের জানান। খবর পেয়ে রাতেই নিহতের মামা ও চাচা হাসপাতালে উপস্থিত হন।
রাজীব হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, যান চলাচল ব্যবস্থা ও দক্ষ চালকের অভাবে প্রতিনিয়ত এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে, যা মোটেও কাম্য নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গত ১০ এপ্রিল ভোর ৪টার দিকে নিউরোলজিক্যাল অবস্থার অবনতি হওয়ায় এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। গত ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। হাতটি বেরিয়েছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে ওভারটেক করার সময় দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
দুই-তিনজন পথচারী দ্রুত তাকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেও বিচ্ছিন্ন সে হাতটি রাজীবের শরীরে আর জুড়ে দিতে পারেননি। পরে ৪ এপ্রিল দুপুরে তাকে শমরিতা হাসপাতাল থেকে ঢামেকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তার চিকিৎসার জন্য সাত সদস্যের একটি চিকিৎসক কমিটি গঠন করা হয়। একইদিন এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজীব হোসেনের চিকিৎসার ব্যয় ওই দুই বাস মালিককে বহন করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। রুলে ওই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ হাত হারানো রাজীব হোসেনকে কেন ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রাষ্ট্রসচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতুসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ আট বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল রিটটি করেন। রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়।
ওইদিন পুলিশ রাজীব হোসেনের হাত হারানোর ঘটনায় জড়িত বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন বাসের চালক মো. খোরশেদকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন ৫ এপ্রিল দুই চালকের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।একইদিন রাজীব হোসেন সুস্থ হয়ে উঠলে তার জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থাও করার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। কিন্তু রাজীব সবাইকে ছেড়ে এখন চলে গেছে সকল চাওয়া-পাওয়ার বাইরে না ফেরার দেশে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় রাজীব মা আকলিমা খানমকে হারান। বাবা শোকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন, ছিলেন নিরুদ্দেশ।
রাজীব ও তার ছোট দুই ভাই পটুয়াখালীর বাউফলে নানার বাড়িতে ছিলেন। পরে ঢাকায় গিয়ে টিঅ্যান্ডটি কলোনির পোস্ট অফিস হাইস্কুলে ভর্তি হন। খালার বাড়ি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব যাত্রাবাড়ীর মেসে গিয়ে ওঠেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। হাত খরচ মেটাতে প্রাইভেট পড়াতেন। দম ফেলার ফুরসত পাননি। লক্ষ্য ছিল একটাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ভাই দুটির দায়িত্ব নেয়া। কিন্তু তা আর হলো না।
রাজীবের মামা জাহিদ জানান, জীবন যুদ্ধ করে হেরে যাওয়া রাজীবের ঘাতক ড্রাইভারদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস