সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর আগে থেকেই ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে লবিং শুরু করেন।
বৃহস্পতিবার মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ ইস্যুতে শিথিলতা প্রদর্শন করার জন্য চাপ দিয়েছিল ভারত।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মার্কিন কূটনীতিকরা এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের এবং সমালোচকদের গ্রেফতার করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন। বাইডেন প্রশাসন বিচারবহির্ভূত অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দেয়।
এ পরিস্থিতির পর ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে বাংলাদেশ বিষয়ে গণতন্ত্রপন্থী মন্তব্য কমানোর দাবি জানান। ভারতীয় কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিল, বিরোধী দলকে উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিলে বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এবং সেখানে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত সরকারের একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, আপনি এটাকে গণতন্ত্রের মানদণ্ডে বিচার করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরা আমেরিকার সঙ্গে বহুবার কথা বলেছি এবং বলেছি, এটি আমাদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। কৌশলগত ঐক্যমতের অভাবে আপনি আমাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন না।
শেষ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ ইস্যুতে সমালোচনা কমিয়ে দেয় এবং শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার হুমকি স্থগিত করে, যা বাংলাদেশের অনেকের জন্য হতাশাজনক ছিল। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, এটি একটি নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল এবং ভারতীয় চাপের সঙ্গে এর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এতদিন প্রকাশ পায়নি।
গত ৫ আগস্ট যখন বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর কারফিউ অমান্য করে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন শেখ হাসিনা ভারতে পালাতে বাধ্য হন। এরপর ভারত ও ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবিলা করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মার্কিন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সবসময় ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। অনেক জায়গায় পরিস্থিতি জটিল এবং অংশীদারদের সঙ্গে এমনভাবে কাজ করতে হয়, যা সব সময় মার্কিন জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে মেলে না।
জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে তা নিয়ে মার্কিন সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেন। তবে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা মনে করতেন, শেখ হাসিনাকে বিচ্ছিন্ন করা খুব একটা লাভজনক হবে না।
ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার নেতিবাচক দিকও বিবেচনা করা হয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে এ বিষয়টি আলোচনা হয়। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও ওয়াশিংটন সফরকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সবসময় উভয় দেশের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বাস্তবতাও বুঝি। বাংলাদেশে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং সেখানে অনেক স্বার্থ জড়িত।
ভারতের জন্য শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক কঠিন সমস্যা তৈরি করেছে। যদিও শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী ও অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, ভারতের সমর্থন অব্যাহত থাকায় ভারত বেকায়দায় পড়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট উল্লেখ করেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর হস্তক্ষেপকারী ও কট্টর জাতীয়তাবাদী দেশ হিসেবে দেখা হয়।
জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কারাগারে পাঠান বা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করেন এবং একতরফাভাবে নির্বাচন আয়োজন করেন। নির্বাচনে তার দল বর ব্যাধানে জয় পাওয়ার দাবি করে। ভারতের কর্মকর্তারা এই নির্বাচনের ফলাফল সমর্থন দেন, যা বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন বাড়িয়ে দেয় এবং মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের প্রভাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোভিজ মন্তব্য করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে এ অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা করা ভুল ছিল।
তিনি আরও বলেন, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনকে নমনীয়তা দেখাতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে, তারা বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পাশে না থেকে ভুল করেছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতের প্রভাবের সমালোচনা করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন সহিংসতা হ্রাস ও অবাধ নির্বাচনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিতর্কিত নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ওপর আরও বিধিনিষেধ না আরোপ করায় কেউ কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছিলেন।
বিক্ষোভের ফলে অনেক প্রাণহানির পর, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কৌশল পরিবর্তন করে জানান, বাংলাদেশের যে কোনো নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ড. ইউনূসকে সমর্থন দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার পর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে অভিনন্দন জানান। ইউনূস আগে শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন জানানোয় ভারতের সমালোচনা করেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, ভারত পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করেছিল যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ নতুন আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অস্ত্র পাচার করে ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল। এ অভিজ্ঞতা ভারতকে শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন দিতে প্রভাবিত করেছে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসতে পারে— এ ধারনা থেকে ভারতীয় কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। তারা হিন্দুদের ওপর হামলা বৃদ্ধির খবরও পেয়েছেন যা বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে দেখানো হয়েছে। বিএনপির নেতারা জানান, তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছেন এবং আশ্বস্ত করেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে।
ভারত হঠাৎ করে তার ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হারানোর ধাক্কা সামাল দিতে চেষ্টা করছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে গুজব চলছে, ওয়াশিংটন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা এ দাবিকে অস্বীকার করেছেন।
নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা বলছেন, এতদিন একজন কর্তৃত্ববাদী শাসককে সমর্থন করার জন্য ভারত দায়ী।
ভারতের একজন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা থেকে আসা প্রতিবেদনগুলোতে ভারতবিরোধী মনোভাব নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবুও আমরা ভেবেছিলাম, শেখ হাসিনা সবকিছু সামলে নেবেন। কিন্তু পুরো ঘটনাটি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসকে