বাংলা৭১নিউজ, টোকন ঠাকুর: ছোটবেলায় আমি বড় হচ্ছিলাম ছোট্ট শহর ঝিনাইদহে, নবগঙ্গা নদীর পাড়ে। এখন আমি বাস করছি অনেক বড় একটি শহরে, ঢাকায়, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত বলা যায়, আমার আত্মজীবনীর নাম- নবগঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা। নদীময় জীবন! বুড়িগঙ্গা শহরে বইমেলা হয়, নবগঙ্গা শহরের প্রধান দুটো সড়কের নাম- গীতাঞ্জলি সড়ক ও অগ্নিবীণা সড়ক। সম্ভবত রবীন্দ্র-নজরুলের অন্যতম প্রধান দুটো কাব্যগ্রন্থের নামে কোনো স্মৃতি-স্থাপনা এদেশে এই দুটোই। ঝিনেদার ওই দুটো সড়কের বয়সও প্রায় সত্তুর ছাড়িয়েছে। একদা কবিতার বইয়ের নামে সড়কের নাম রেখেছিলেন ঝিনাইদহের প্রথম পৌরসভা চেয়ারম্যান ডা. কে, আহম্মদ। আমি যখন ঝিনেদা সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র, তখন, শহরের কাঞ্চননগরে ডা. কে, আহম্মদের বাসার নিচতলাতেই ছিল জেলার সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি। খুব যেতাম, কারণ, বইয়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল ব্যক্তিগত প্রণয়। প্রণয়ই তো বটে! বই ভাল্লাগতো। বই ভাল্লাগে। তাই বই ভালোবাসি। বইমেলাও ভালোবাসি।
তখন, সেই জেলা শহরের কলেজে পড়া দিনে আমি একুশের বইমেলায় এসেছি। তখন, ঢাকায় এসে থাকব কোথায়- সে ছিল এক চিন্তা। তাই ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে হয়তো থাকতাম দু’একদিন, আমাদের এলাকার কোনো বড় ভাইয়ের রুমে। তখনকার বইমেলার চেহারা আমার একটু একটু মনে আছে। একবার রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে আমি দূর থেকে দেখেছিলাম বইমেলায়, বাংলা একাডেমি চত্বরে। রুদ্রদা’কে আরেকবার দেখলাম টিএসসির গেইট বরাবর একটি টেবিল পেতে নিজের কাব্যগ্রন্থ ‘মৌলিক মুখোশ’ বিক্রি করছেন। কবির কপালে-মাথায় লাল ফিতা বান্ধা। আমি তখন ঢাকা চারুকলায় ভর্তির জন্যে কোচিং করছিলাম। এরশাদ শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তখন শহর টালমাটাল, মিছিল-মিটিং-সমাবেশই তখন ছাত্রদের নিত্যদিনের কাজ। চলছিল।
আমার তখনকার দেখা বাংলা একাডেমি চত্বরের বইমেলা স্বপ্নের মতো লাগত। বড় বড় কবি-সাহিত্যিকদের দূর থেকে তাকিয়ে দেখতাম, যাদের লেখা আমার ততদিনে অনেকটাই পড়া হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। সেসময় আমার মনে হতো, হয়তো কবিতার ভক্ত বলেই মনে হতো, অকালপ্রয়াত কবি আবুল হাসানের সঙ্গে আমার বইমেলা চত্বরে দেখা হয়ে যাবে! যদিও হাসান মারা গেছেন সেই কত বছর আগে। মনে হতো, সুরাইয়া খানমের সঙ্গেও। কিন্তু, কখনো সুরাইয়াকে দেখিনি, শুধু ‘নাচের শব্দ’ পেয়েছি।
তারপর যখন ঢাকাতে পাকাপাকিভাবে চলে এলাম, সে্টা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবার সুবাদে, তখনকার বইমেলাও আমার মনে আছে। আমার বন্ধুরা আর বইমেলা প্রায় সমার্থক এক গুঞ্জরণ। আমার বন্ধুরা আর বাংলা কবিতা এক তর্ক-বিতর্কের সম্মিলন। আমার বন্ধুরা আর চিত্রকলাচর্চা একপটে রচিত আখ্যান। আমার বন্ধুরা আর নাটক-সিনেমায় চিত্রিত দিনরাত একাকার। এটা বলতেই পারি আমি, অনেকবছর ধরে আমি এসবের মধ্যেই বড় হয়ে উঠছি। আমার চারপাশে উচ্চারিত হচ্ছে নতুন নতুন বাংলা কবিতা, তার বাঁক বদলাবার নড়াচড়া। আমার ঘরের চতুষ্কোণে ছবি-গল্প-উপন্যাস ছড়িয়ে আছে। আমার বাড়ির উঠোনে প্রতিদিন সিনেমা প্রদর্শিত হয়। গান বাজে অহর্নিশ। এর মধ্যেই বছরে একবার করে বইমেলা আসে, পহেলা ফাল্গুন আসে, ফাল্গুনের ঘটনাবলি উড়ে আসে। আসে তো আসেই। আসে আর যায় না। মনে মনে বইমেলা থেকে যায়। মনে মনে ফাল্গুন থেকে যায়, মনে মনে ফাল্গুন নেচে যায়। তাই নিয়ে থাকি। আর কিছু করি না। আর কিছু ভাল্লাগে না। কারণ, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু করব না- কথা দিয়ে এসেছি। কার কাছে কথা দিছি?
কার কাছে কথা দিছি- নাম বলতে হবে? কেন নাম বলতে হবে? কার কাছে কী কথা দিছি, তা আজ লিখব কেন? গোপন বলে কি কিছুই থাকবে না? রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করা যায়। লোকটা বলেছিলেন, ‘সখি, তোমার গোপন কথাটি রেখো না মনে…।’ শারীরিকভাবে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি তো একুশের বইমেলায় আসতেনই, হয়তো পোলাপান তাকে ধরে নিয়ে আসত বহেড়াতলায়, লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে, তারপর কী হতো? বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় বহেড়াতলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন, আড্ডা দিচ্ছেন তরুণ কবিদের সঙ্গে- এভাবে ভাবা যায়? এর মধ্যে দু’একজন করে ভক্ত জমে যেত, অটোগ্রাফের খাতাটা বাড়িয়ে দিত, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুখ একটু আঁকাবাঁকা করে মেয়েরা সেলফি তুলত। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের সেলফোন বেজে উঠতেই ওপাশে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ‘আপনি ওখানে? কখন এলেন? আসার আগে একটা মিসডকলও দিলেন না!’
আরো কিছু মেয়ে চলে এসেছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেলফি তুলতে। সেই হুড়োহুড়িতে পড়েই রবীন্দ্রনাথের আইপ্যাড চুরি, পরে সেটা উদ্ধার করার জন্যে একাডেমির কমিটি গঠন, পুলিশ-র্যাব-সাংবাদিক ভরে যাবে। এসব হতে পারত রবীন্দ্রনাথ আর কিছুদিন বেঁচে থাকলেই। তার মানে কী? বেঁচে থাকার একটা আকাঙ্ক্ষা আমাদের থেকেই যাচ্ছে। ‘বাঁচতে চাই’ একটা ব্যাপার, মানবজীবনে।
বই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। যে-কারণে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বেঁচে আছেন, জীবনানন্দ দাশ বেঁচে আছেন, আবুল হাসানের মতো অকালপ্রয়াত প্রতিশ্রুতিময় মেঘও বেঁচে আছেন। আমরাও বেঁচে থাকতে চেয়েছি। চেয়েছি বলেই ‘বই’ লিখি। ঢুকতে চাই পাঠকের পরম-অন্তরে। কেন? ওই যে, বেঁচে থাকব বলে।
বেঁচে থাকাটা কেন? ওই যে, ভালোবাসব বলে। প্রতিটি প্রাণ বেঁচে থাকতে চায়। প্রতিটি প্রাণ বেঁচে থাকতে চায়। এ এক জন্মগত চাওয়া। তাহলে প্রতিটি মানুষই তো বেঁচে থাকতে চায়, ভালোবাসতে চায়, প্রতিটি মানুষই কি গান গায়? কবিতা লেখে? ছবি আঁকে? ছবি বানায়?
আমার মনে হয়, হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষেরই গান আছে হৃদয়ে, গল্প-কবিতা-ব্যথা আছে অন্তরে, ছবি আছে চোখে। সে ছবি প্রদর্শিত হয় না, সে কবিতা ছাপা হয় না। সে গান, যে গান হাহাকার, তা শোনে না কেউ। কত নারী, কত পুরুষ, কত ছেলেমেয়েদের মনে কত কথা, সব কি ছাপা হয়? সে সব কেউ জনতেও পারে না। জনপদের প্রত্যেকটি মানুষেরই আলাদা আলাদা জীবন, কিন্তু সেই জীবনের প্রকাশ হয়তো ঘটে না। আমরা জানতে পারি না। সেই মানুষেরা বইমেলায় আসে না। সেই মানুষেরা হয়তো বিনয় মজুমদারের নাম শোনেনি, গায়ত্রী চক্রবর্তী কীভাবে স্পিভাক হয়ে গেল- তা হয়তো তারা জানে না। তাতে কি? গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক কি জানেন, কুমিল্লার তনু মেয়েটি কীভাবে মরে গেল? ফালানি কীভাবে কাঁটাতারে ঝুলছিল? কিংবা বিনা বিচারে ১৭ বছর জেল খেটে যে মানুষটা এখন ‘মুক্ত’, তার বিভ্রান্ত জীবনে কয়টা বাক্য, কয়টা শব্দ, কী সেই শব্দ, কী সেই নৈঃশব্দ- আমিও কি জানি! আমি তো বই পড়ি, বই কিছু লিখেছিও, কিন্তু আমি কি জানি, পাহাড়ের মেয়ে কল্পনা চাকমার ভাগ্যে শেষ মুহূর্তে কি ঘটেছিল? আমিও তো বইমেলায় যাই, কিন্তু কোনোদিন তো যাইনি নাগরিকদের পুড়িয়ে দেওয়া আগুন-অর্থনীতির শিকার ঢাকার বস্তির মানুষেরা শেষ পর্যন্ত কে কোথায় গিয়ে ফের নতুন বসতি পায়! অথচ আমরাই স্বীকার করে ফিরছি যে, প্রতিটি মানুষ একেকজন গুরুত্বপূর্ণ কিছু!
মানুষ মানুষকে কনজুমার করে চলা এক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। বইমেলাও তারই অংশ। খুব দুর্ভাগ্য মানুষের। মানুষ এর বাইরে আজ আর কিছু চলা জানে না, বেঁচে থাকা জানে না। তাহলে কবির ভাষাতেই প্রশ্ন করি: ‘কতদূর এগুলো মানুষ!’
উপসংহারে যাই। বইমেলা চলছে। ফাল্গুন-বসন্ত এখন। কোকিল ডাকছে। কোকিল কবিতা পড়ছে। কোকিল কবিতা পড়লে লোকে বলে, কোকিল ডাকে রে। কোকিলও কবি। কবির সংখ্যা অনেক। এ নিয়ে বাংলায় শ্লেষ চালু থাকলেও কবিতার পাঠক যে খুব কম, তা প্রায় সব্বাই জানে। আমি মনে করি, এতেই কবিতার মঙ্গল। কবিতা মুড়িমুড়কি নয়, যে গাল থাকলেই খাওয়া যাবে। অনেক মানুষের ভিড়ে নির্ঘুম কেউ কেউ রাত জেগে কবিতা পড়ে, সেই লগ্নে পাঠক ও কবির দূরত্ব ঘুঁচে থাকে। তারা সখা হয়ে বসে থাকে চুপচাপ, মুখোমুখি। এই মুখোমুখির নাম- ভালোবাসা।
৩৬ নম্বর ভূতের গলি, পুরানো ঢাকা
বাংলা৭১নিউজ/এন