বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক:দেশে এখন খাদ্যশস্যের পাশাপাশি অন্যান্য কৃষিপণ্যেরও আবাদ বাড়ছে। কৃষির বহুমুখীকরণের সুবাদে এখন বিভিন্ন জাতের ফল, ফুল, সবজি ও ডাল শস্যের বাণিজ্যিক আবাদে ঝুঁকছেন কৃষকরা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে আবাদ প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ফল ও ফুল। একই সঙ্গে সবজি, ধান ছাড়া অন্যান্য খাদ্যশস্য, তেলবীজ, মসলাপণ্য ও ডাল শস্যের আবাদও সম্প্রসারণ হয়েছে ব্যাপক হারে।
বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির দুই-তৃতীয়াংশেরই বেশি জুড়ে চাষ হয় প্রধান খাদ্যশস্য ধান। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও বহুমুখীকরণে জোর দিয়ে সরকার ও ব্যক্তি খাতের পক্ষ থেকে নেয়া বেশকিছু উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় অন্যান্য শস্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের দিকেও এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষকরা। ফলে এসব শস্য ও কৃষিপণ্যের আবাদ এলাকা এখন বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় কৃষিপণ্যের বহুমুখীকরণ কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার ওপর জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের এক সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে ফলের আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে ১০২ শতাংশ। আবাদ প্রবৃদ্ধির দিক থেকে এর পরের অবস্থানেই রয়েছে ফুল চাষ—৯১ শতাংশ। এছাড়া আঁশজাতীয় পণ্য ও মসলাপণ্যের আবাদ এলাকা বেড়েছে যথাক্রমে ৭৩ ও ৬৩ শতাংশ হারে। এছাড়া ডাল শস্যের আবাদ এলাকা ৬১ শতাংশ, ভুট্টার ৪৮, পশু খাদ্যের ৩৫, গমের ৩৫, আলুর ৩১ ও ধানের আবাদ এলাকা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে শীতকালীন সবজির ২৯ শতাংশ, তেলবীজের ২৮, চিনি শস্যের (আখ) ২০ ও গ্র্রীষ্মকালীন সবজির ৩ শতাংশ হারে আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে।
এক দশক আগে পর্যন্তও সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে ফলের উৎপাদন হতো খুবই কম। এ সময় ভোক্তাদের আমদানীকৃত ফলের ওপরই নির্ভর করতে হতো সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশেই কুল, তরমুজ ও বাঙ্গিসহ বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বেড়েছে। পাশাপাশি আবাদ বাড়ছে নতুন জাতের আম, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফলসহ বিভিন্ন বিদেশী জাতের ফলের। সব মিলিয়ে গত এক দশকে দেশে ফলের আবাদ এলাকার সম্প্রসারণ হয়েছে প্রায় ১০২ শতাংশ। ফলের বাণিজ্যিক আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকরা যেমন লাভবান হয়েছেন, তেমনি ভোক্তা পরিমণ্ডলেও এখন ফলের প্রাপ্যতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমানে গোটা বছরজুড়েই মৌসুমি দেশী ফলের পাশাপাশি বারোমাসি ও বিদেশী ফলেরও আবাদ করছেন কৃষকরা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে সব ধরনের ফলের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ ৪৮ হাজার টন। চলতি মৌসুমে তা অর্ধকোটি টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন লক্ষ্য আমের—প্রায় ২২ লাখ ৩২ হাজার টন। এছাড়া কাঁঠাল ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টন, কলা ৮ লাখ ৩৩ হাজার, আনারস ৪ লাখ ৯৭ হাজার ও লিচু ২ লাখ ৩২ হাজার টন উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। সাধারণত টাঙ্গাইল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও নাটোর জেলায় এ পাঁচ ফলের উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলের মাধ্যমে চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। বিদেশী ফলের মধ্যে ড্রাগন ও মাল্টার উৎপাদন যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর কয়েক বছরের মধ্যেই স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বড় আকারে রফতানিরও সুযোগ তৈরি হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
অন্যদিকে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ শুরু হয় ১৯৮৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী ও পানিসারায়। বর্তমানে দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই মেটাচ্ছে যশোর অঞ্চল।
সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোর অঞ্চলেই প্রায় অর্ধেক। এখানকার প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করা হচ্ছে। ধান-পাটের পাশাপাশি সারা বছর ফুল চাষেও ব্যস্ত থাকছেন এখানকার কৃষকরা। তাদের উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, ক্যালেনডুলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পণ্যটির বাণিজ্যিক আবাদ এখন যশোরের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইলেও সম্প্রসারিত হয়েছে।
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার জানান, সারা দেশেই এখন ফুলের চাহিদা বাড়ছে। মাটির গঠন ও আবহাওয়ার কারণে যশোর অঞ্চলে ফুলের আবাদ বাড়ছে। শুধু যশোরেই দেড় হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে। এখানকার ফুল এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি হচ্ছে।
বাণিজ্যিকভাবে আরো লাভবান করার পাশাপাশি রফতানিমুখিতা বাড়াতে হলে কৃষির বহুমুখীকরণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, কৃষিতে এখনো ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ হয়নি। দেশের কৃষি এখনো ভরণপোষণের (সাবসিস্টেন্স) পর্যায়েই রয়ে গিয়েছে। আমাদের মতোই বদ্বীপ দেশ নেদারল্যান্ডসের প্রাথমিক কৃষিপণ্যের রফতানি ৯৬ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু আমরা রফতানি করি মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলারের। আবার বহুমুখীকরণের নামে সব পণ্য উৎপাদনে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। সেক্ষেত্রে শস্য উৎপাদনের তুলনামূলক সুবিধা বিশ্লেষণ, ভূপ্রাকৃতিক গঠন, বাজারদর, আবহাওয়া উপযোগিতা, মাটির কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়কেও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে কিছু পণ্যে যে বহুমুখিতা শুরু হয়েছে, সেটি বেশ আশার কথা। এটিকে আরো বেগবান করতে হলে উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই।
দেশে ধান ছাড়া অন্য যেসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন এখন বাড়তির দিকে সেগুলোর মধ্যে এখন ভুট্টাই সবচেয়ে এগিয়ে। যদিও ভুট্টার সবচেয়ে বেশি প্রচলন গোখাদ্য ও মৎস্য খাদ্য হিসেবে। গত এক দশকে দেশে শস্যটির আবাদ বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও দেশে পণ্যটির উৎপাদন ৩৩ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়।
দেশে ভুট্টা সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয়। এর মধ্যে দিনাজপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলা পণ্যটি উৎপাদনের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। এ দুই জেলায় পণ্যটির মোট উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় সমান- কমবেশি ১০ লাখ টন। এছাড়া মেহেরপুর, লালমনিরহাট, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারীতেও পণ্যটি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়ে থাকে।
উপযোগী আবহাওয়া, মাটি ও উচ্চফলনশীল জাত কাজে লাগিয়ে দেশে এখন আলুর আবাদও বাড়ছে ব্যাপক হারে। দেশে আলুর উৎপাদন এখন প্রায় এক কোটি টন। গত এক দশকে দেশে পণ্যটির আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণে। কৃষিপণ্যটি উৎপাদনে বিশ্বে বর্তমানে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বাড়াতে নতুন জাত উদ্ভাবন করে সেগুলো দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। ভুট্টা এক সময়ে প্রধান ফসল হিসেবে গণনা করা হতো না। সে ভুট্টাই এখন দেশের অন্যতম প্রধান শস্য। একইভাবে আলুরও আবাদ বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। পণ্যটি উৎপাদনের বৈশ্বিক তালিকায় আমরা অবস্থান নিতে সমর্থ হয়েছি। সামনের দিনগুলোয় প্রয়োজনীয়তা ও তুলনামূলক খরচের বিষয়গুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে শস্য আবাদের বহুমুখীকরণকে আরো বেগবান করা হবে।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র:বণিক বার্তা