বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দু’দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে ফিরে গেছেন। তার এ সফরকে মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের কয়েকটি বিষয় দেখার আছে। প্রথমত, আমাদের বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি।
আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিটি আর হচ্ছে না। যেহেতু জয়শঙ্কর অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কথা বলেছেন এবং এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য পদ্ধতি খুঁজে বের করার কথা বলেছেন, এমনকি তাতে উভয়পক্ষের একমত হওয়ার কথাও শোনা গেছে। এ গেল এক কারণ।
তিস্তা চুক্তি না হওয়ার আরেকটি কারণ সিকিমে অনেকগুলো হাইড্রো ড্রাম তৈরি হচ্ছে। শীতকালে সেখানে তেমন একটা পানি থাকে না। ফলে হাইড্রো ড্রামগুলো চালু রাখার জন্য কী পরিমাণ পানির দরকার, পশ্চিবঙ্গের সঙ্গে কতটুকু ভাগাভাগি করা সম্ভব হবে সেটি বিবেচনায় নিয়েই দিল্লি কার্যত তিস্তা বাদ দিয়ে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের সম্ভাব্য পদ্ধতি খুঁজে বের করতে বলেছে।
যদিও এতদিন দিল্লি পশ্চিমবঙ্গের দোষ দিয়ে বাংলাদেশকে আশা দিয়েছিল। আসলে এতদিন তারা রাজনীতির খেলা খেলেছে এবং এখন বিষয়টি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে। ফলে আমি মনে করি, এ চুক্তি আর হচ্ছে না।
এখানে একটি বিষয় দেখার আছে। কিছুদিন আগে আমাদের হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছেন, যাতে সব নদীকে জীবিত সত্তা হিসেবে উল্লেখ করে নদীর জীবন টিকিয়ে রাখার তাগিদ ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই মূলনীতিতে আমি মনে করি, হাইড্রো ড্রাম করে নদীকে মেরে ফেলা ও নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না। নদীকে বাঁচাতে হবে। এটা একটা বিষয়।
এর বাইরে পানি ছাড়াও নদীর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত। যেমন- নদীতে এনার্জি আছে, অনেক প্রতিবেশ বৈচিত্র্য বা বায়োডাইভারসিটি আছে, পলিমাটি আছে। পানি ভাগাভাগি করা গেলেও এগুলো তো আর ভাগাভাগি করা যায় না। সেই জায়গায় নদী নিয়ে যা খুশি করার উপায় নেই। তবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আর আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার তা হল রোহিঙ্গা ইস্যু। তারা বলছে, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারকে আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে হবে। এই প্রথম ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্পষ্ট কথা বলল। এটি অবশ্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ-চীন সমঝোতার চাপের একটি প্রতিফলন। যদিও ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেছে, তবে এক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমরা আশা করব, কেবল ঢাকায় নয়, ইয়াঙ্গুনে গিয়েও জয়শঙ্কর একই ধরনের কথা বলবেন। না হয় ফলপ্রসূ কোনো কিছু বের হবে না। সামনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন। সেখানে যৌথ ইশতেহারে আমরা যেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উল্লেখ পাই। সেটা না হলে জয়শঙ্করের বক্তব্যের কোনো ফল পাওয়া যাবে না।
তৃতীয়ত, কাশ্মীর ইস্যু। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে আমরা দেখতে চাই। তবে কাশ্মীর একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের অঞ্চল। সেখানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাব আছে কাশ্মীর নিয়ে। আছে একাধিক দেশের সংযোগের বিষয়ও। তবে এটা নিয়ে আমাদের তেমন কিছু বলার নেই।
সর্বশেষ বিষয়টি হল ভারতের কিছু রাজ্যের সমস্যা। যেমন- আসামের নাগরিকপঞ্জি। জয়শঙ্কর বলেছেন, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যদি তাই হয়, তবে আমরা আশা করব তারা এমন কোনো মন্তব্য করবেন না যাতে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী পক্ষ এবং ভারতে বাংলাদেশবিরোধী পক্ষ হৈচৈ ও নৈরাজ্য তৈরি করার সুযোগ পায় ও উৎসাহী হয়।
কিন্তু আমরা দেখছি, ভারতের অনেকে আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা করছেন এবং ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ ‘বাংলাদেশে’ ফেরত পাঠানোর মতো জঘন্য মন্তব্য করছেন। যদি নাগরিকপঞ্জি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়, তবে কেন আমাদের সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা? মনে রাখতে হবে, যারা এ ধরনের উসকানি দিচ্ছেন, মন্তব্য করছেন, তারা জয়শঙ্করের চেয়ে বড়মাপের ও প্রভাবশালী নেতা। (অনুলিখন)।
বাংলা৭১নিউজ/লেখক : ড. ইমতিয়াজ আহমেদ , অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়