ঢাকার সাভারে গড়ে ওঠা ট্যানারির বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে কেরানীগঞ্জ উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী নদীর পানি। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বর্জ্যের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, প্রতিনিয়ত নদীর নতুন নতুন এলাকা দূষণের কবলে পড়ছে। নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। গোসল করলে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্যানারি শিল্পনগরীতে কারখানায় তরল, কঠিন ও বায়বীয় তিন ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য পরিশোধন করার কথা থাকলেও কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীর পাড় দিয়ে।
গতকাল ৩০ জুন কেরাণীগঞ্জ উপজেলার হজরতপুর ইউনিয়নের কানার চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ট্যানারিগুলো থেকে পানি সরাসরি পাইপের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। কালো রঙের রাসায়নিক মিশ্রিত পানি সরাসরি পড়ছে নদীতে। খোলা অবস্থায় রাখা হয়েছে কঠিন বর্জ্য। এই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের এলাকায়।
কানার চর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভরা মৌসুমে রাসায়নিক মিশ্রিত পানি উপচে পড়ে নদী ও সড়কে। বৃষ্টির সময় ডাম্পিং ইয়ার্ড উপচে কঠিন বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে। নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। গোসলসহ অন্যকাজে এই পানি ব্যবহার করলে চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।
ট্যানারির অদূরে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করা হচ্ছে একটি মাদরাসা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার সময় টেকা যাচ্ছিল না ট্যানারির দুর্গন্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদরাসার প্রিন্সিপাল বলেন, আমাদের এখানে ১৫০ জন ছাত্র বোর্ডিংয়ে থেকে পড়ালেখা করে। ট্যানারির দুর্গন্ধে প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ অসুস্থ হচ্ছে। আমরা অনেক জায়গায় অভিযোগ করেছি। কোনো লাভ হয়নি। আমরা এই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাই। আমাদের ছাত্ররা যেন ভালো পরিবেশে পড়ালেখা করতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী বলেন, ‘ট্যানারির গন্ধের কথা কী বলবো। আমরা এলাকাবাসী অনেক যায়গায় অভিযোগ করেছি। কোনো প্রতিকার হয়নি। আমাদের এলাকার অনেকেই এই দুর্গগ্ধের কারণে অসুস্থ হচ্ছেন।’
এলাকার মুরুব্বি জয়নাল বলেন, ‘যখন আমাদের এলাকায় ট্যানারি আসে তখন গন্ধে আমাদের ভাত খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিলো। এমন দুর্গন্ধ যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমাদের এই এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সেখানে দেখি, ছেলে-মেয়েরা মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়। সত্যি বলতে আমরা এই দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি চাই। প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই৷’
যুবক মমিন বলেন, ‘ট্যানারি শুধু আমাদের এলাকার পরিবেশ দূষিত করেনি, যে ধলেশ্বরী নদীতে গোসল করতাম ও মাছ ধরতাম সেই নদীও আজ বিষাক্ত হয়ে হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্যে৷ আমরা দূষণ মুক্ত পরিবেশ চাই, দূষণ মুক্ত নদী চাই।’
কানার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শামীমা আক্তার বলেন, ‘ট্যানারির দুর্গন্ধের মধ্যেই ক্লাস পরিচালনা করতে হচ্ছে। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুর্গন্ধে অসুস্থ হয়। দুর্গন্ধ নিরসনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করছি।’
উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা অফিসার শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘আমাদের কানার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই ট্যানারির ময়লার স্তূপ। আমি প্রতি মাসেই স্কুল পরিদর্শনে যাই। দুর্গন্ধে বেশি সময় থাকা যায় না স্কুলটিতে।’
কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু রিয়াদ বলেন, ‘যেহেতু সেখানে একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাই এলাকাটি পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন করা হয় নিয়মিত। এখানকার বর্জ্যও ফেলা হয় নির্দিষ্ট ডাম্পিং ইয়ার্ডে। সম্প্রতি জম জম সিটির পাশে অপর একটি ট্যানারি গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে হয়তো দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে।’
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘সলিড ওয়েস্ট থেকে গন্ধ ছড়িয়ে থাকতে পারে। আমরা ঈদের আগে ট্যানারিতে দুইটি পুকুর খনন করেছি। নদীতে আমাদের বর্জ্য ফেলা হয় না। এখানে তা পরিশোধন করা হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে গন্ধ কমে আসবে।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ