সাখাওয়াত হোসেন বাদশা: ভারতের ইচ্ছার ওপর আটকে আছে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক। চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করেও শেষাবধি বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। এভাবেই ছয় বছরেরও অধিক সময় ধরে জেআরসি’র বৈঠক বসছে না। কেন হচ্ছে না, কী কারণে এই বৈঠক নিয়ে দিল্লীর অনীহা-এর কোন কারণও বাংলাদেশকে জানানো হয়নি। ভারতের এই অনীহায় বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ।
অথচ এই বৈঠকের জন্যই আটকে আছে দু’দেশের অনিষ্পন্ন অনেক বিষয়। যার মধ্যে রয়েছে তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তি, সীমান্ত নদী ভাঙন প্রতিরোধ কাজ, গঙ্গা চুক্তি পর্যালোচনা, সুরমা ও কুশিয়ারা ড্রেজিং, ফেনী নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বন্ধ করাসহ অনেক অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল অনুযায়ী বাংলাদেশ গেল শুষ্ক মৌসুমে একটিবারের জন্যও পানি পায়নি। এমনকি বাংলাদেশকে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার যে গ্যারান্টি ক্লজ রয়েছে তা মানা হয়নি।
জেআরসি’র পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, গঙ্গা চুক্তি মোতাবেক শুষ্ক মৌসুমের শেষ দশ দিনেও (২১ থেকে ৩১ মে) বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা। আর চুক্তির ২ এর ইন্ডিকেটিভ সিডিউল অনুযায়ী এই দশদিনে পাওয়ার কথা ৪১ হাজার ৮৫৪ কিউসেক। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে এই পরিমাণ পানি দেয়নি। এই দশদিনে বাংলাদেশ পানি পেয়েছে ২৯ হাজার ৪৮৯ কিউসেক। একইভাবে ১১ থেকে ২০ মে এই দশদিনে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা ৩৫ হাজার কিউসেক। কিন্তু পেয়েছে ২৬ হাজার ১৫৫ কিউসেক।
ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহ প্রভাবে কারণে বাংলাদেশ স্মরণকালের সর্বনিম্ন পানি পায় ২১ থেকে ৩১ মার্চ এই দশদিনে। এই সময়ে মাত্র ১৫ হাজার ৬০৬ কিউসেক পানি দিয়েছে ভারত। এরপর ১ থেকে ১০ মে বাংলাদেশকে দেয়া হয় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পানি যার পরিমাণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৬৪৮ কিউসেক। আর ১১ থেকে ২০ এপ্রিল ভারত বাংলাদেশকে তৃতীয় সর্বনিম্ন পানি দেয়। যার পরিমাণ হচ্ছে ১৮ হাজার ২৮২ কিউসেক। চুক্তির পর থেকে বাংলাদেশ গঙ্গার পানি নিয়ে এত ভয়াবহ ভোগান্তির কবলে আর পড়েনি।
ভারতের সাথে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী প্রতি শুষ্ক মৌসুমেই উভয় দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি হয়। চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগির যে সূচনা ঘটেছিল ১ জানুয়ারি, ৩১ মে তা শেষ হয়েছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমের পুরো সময়টাই পানি নিয়ে গোটা পদ্মা অববাহিকা জুড়েই ছিল হাহাকার। এদিকে ভারতের সাথে সীমান্ত নদীর অধিকাংশই ভাঙন প্রবণ। বর্ষায় পানি বৃদ্ধির সময় একবার এবং পানি নেমে যাওয়ার সময় একবার এসব নদীতে ভাঙন দেখা দেয়।
বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, ভাঙনের কারণে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৫০ হাজার একর জমি হারিয়েছে। তবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জমি হারানোর পরিমাণ ৩০ হাজার একরের বেশি হবে না। জেআরসি’র একাধিক বৈঠকে বাংলাদেশ ওপারে (ভারতীয় অংশে) জেগে উঠা ভূমি ফিরিয়ে আনার বিষয়টি উত্থাপন করলেও ভারত তা আমলে নেয়নি।
এতে করে সুরমা, কুশিয়ারা, আত্রাই, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মাতামুহুরি, ইছামতি, কালিন্দী, রায়মঙ্গল, তিস্তা, গোমতী, ফেনী, পুনর্ভবা, মহানন্দা, গঙ্গা (পদ্মা)সহ বিভিন্ন নদী ভাঙনে বাংলাদেশ তার মূল্যবান ভূমি হারাচ্ছে। আর এসব ভূমি জেগে উঠছে ওপারে ভারতীয় অংশে। হারানো এসব ভূমিতে বাংলাদেশের কৃষকরা আবাদের জন্য যেতে চাইলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র বাধার কারণে যেতে পারে না। এতে করে সীমান্ত নদীবর্তী মানুষগুলো ক্রমান্বয়ে নিজেদের বসতবাড়ী, আবাদী জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
ভাসমান মানুষ হিসাবে তারা আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত নদী ভাঙন ঠেকাতে তারা কোন কাজ করতে পারছে না। কাজ করতে গেলেই বিএসএফ’র বাধার মুখে পড়তে হয়। অথচ ভারতীয় অংশে নদী ভাঙন কার্যক্রম চলে বছর জুড়েই। তিস্তা, গঙ্গা, কুশিয়ারা, ইছামতি, মহানন্দাসহ অধিকাংশ সীমান্ত নদীতে ভারত পরিকল্পিতভাবে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করছে। এসব স্থাপনা নির্মাণের কারণে বাংলাদেশ অংশে ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে।
জেআরসি’র বৈঠক না হওয়ায় এ বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ কোন আলোচনা করতে পারছে না। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র বাধার কারণে বারবার আটকে যাচ্ছে জকিগঞ্জে পাম্প হাউজ নির্মাণ কাজ। ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় সম্বলিত এই প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে একাধিকবার ভারতের সাথে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কোন সুফল আসেনি। এ ব্যপারে পাউবো’র বক্তব্য হচ্ছে, জেআরসি’র বৈঠক বসলে এসব সমস্যা এতটা প্রকট হতো না।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, জেআরসির বৈঠকের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে অভিন্ন নদীর পানি সমস্যার সমাধানের বিষয়টি। বিশেষ করে জেআরসি’র বৈঠক না বসার অর্থ তিস্তা চুক্তি নিয়ে কালক্ষেপণ করা। চুক্তি না থাকার কারণে তিস্তার নাব্য সঙ্কট মারাত্মক রূপ নিয়েছে। ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি পর্যালোচনা হচ্ছে না। আটকে আছে ৫৪টি সীমান্ত নদীর অমীমাংসিত অনেক বিষয়াদি।
জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের সর্বশেষ ৩৭তম বৈঠকটি বসেছিল ২০১০ সালে মার্চে দিল্লীতে। আর ৩৮তম বৈঠকটি হওয়ার কথা ঢাকায়। ইতোপূর্বে ২০১৩ সালের ১৮-১৯ জুন ঢাকায় জেআরসি’র ৩৮তম বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। ওই সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু প্রস্তুতির প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে দিল্লীর পক্ষ থেকে বৈঠকটি বাতিল করা হয়। কেন এবং কী কারণে এই বৈঠক বাতিল করা হয়েছিল-তার বিশেষ কোনো কারণও বাংলাদেশকে জানানো হয়নি।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গতকাল বলেন, গঙ্গা চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পানি পাচ্ছেনা-বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে ভারতকে জানিয়েছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আসা করে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গার চুক্তি মোতাবেক পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করবে। তিনি দীর্ঘ ৬ বছর ঝুলে থাকা জেআরসি বৈঠকের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, এই বৈঠকটি হলে দু’দেশের মধ্যে অমীমাংসিত অনেক সমস্যারই সমাধান হত।
বাংলা৭১নিউজ/সৌজন্যে: ইনকিলাব