করোনা মহামারিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পুঁজি হারিয়ে করছেন হা-পিত্যেশ। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে গ্রামমুখী। সংসার চালাতে গিয়ে খাবি খাচ্ছেন অনেকে। সঞ্চয় ভেঙে মানুষ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালাচ্ছে জীবনচাকা। আবার কারো কারো যেটুকু সঞ্চয় আছে সেখানেও বসছে নানামুখী থাবা। উচ্চবিত্তরা হরেক রকম প্রণোদনা পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে মধ্যবিত্তদের জন্য তেমন সুখবর নেই। উল্টো তাদের সঞ্চয়ে বারবার হাত পড়ছে। ব্যাংকে টাকা রেখে কম মুনাফার কারণে অনেকেই সঞ্চয়পত্র কিনে কিছুটা স্বস্তি খোঁজে।
এবার সেখানেও পড়ল কোপ। ফলে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত আয়ের মানুষের দুঃখী মনে নতুন করে নেমে এসেছে আঁধার! অতিমারিতে এমনিতেই মানুষের জীবন ছন্দহীন। নতুন এই পদক্ষেপে তাদের জীবনযাত্রা আরো ‘বন্ধুর’ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ছয় রকমের জাতীয় সঞ্চয়পত্রের স্কিমে এখন থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফা মিলবে কম। বিনিয়োগসীমা ৩০ লাখ টাকা পেরিয়ে গেলে লাভ আরো কমে আসবে। তবে ১৫ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার আগের মতোই থাকবে। প্রজ্ঞাপন জারির পর যাঁরা নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনবেন, শুধু তাঁদের জন্য পরিবর্তিত এই হার কার্যকর হবে। তবে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেটি ফের বিনিয়োগ করলে তখন থেকে নতুন মুনাফার হার কার্যকর হবে। তিন ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করে গত মঙ্গলবার নতুনভাবে মুনাফার হার পুনর্বিন্যাস করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রকৃত নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন আরো নাস্তানাবুদ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প কম। বয়স্ক অনেক মানুষ তাঁদের জীবনযাপনের ব্যয় সঞ্চয়পত্রের আয় থেকে করে থাকেন। সরকার ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদহার অপরিবর্তিত রেখেছে ছোট ও মাঝারি সঞ্চয়কারীদের সুবিধার্থে। তবে অনেক অবসরপ্রাপ্ত ও বয়স্ক নাগরিক আছেন, যাঁদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় এর চেয়ে বেশি এবং তাঁরা সঞ্চয়পত্রের আয় থেকেই চলেন। তাঁদের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ করা কঠিন হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ গরিব হয়ে যাচ্ছে, কিংবা কেন মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্তে চলে যাচ্ছে সেটা দেখতে হবে। এটাকে শুধু সঞ্চয়পত্র দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাবলয় কর্মসূচি চালু করতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, আমরা কেন এখনো মানুষকে পেনশন এবং বেকার ভাতা দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই, সর্বজনীন পেনশন নেই, সেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর টিকে থাকার অবলম্বনই হলো সঞ্চয়পত্র। সেখানেও সুদহার কমে গেলে নির্ভরশীল মানুষের ওপর অভিঘাত আসবে। করোনায় এমনিতেই মানুষের আয় কমে গেছে। এক আঘাতের ওপর আরেক আঘাত পড়ল।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এখনো সঞ্চয়পত্র দেশের মানুষের নিরাপদ বিনিয়োগক্ষেত্র। কম ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ এই খাতে বিনিয়োগ করে। ১৫ লাখের বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমায় এক ধরনের মানুষ কিছুটা চাপে পড়বে। আবার সুদহার বেশি থাকায় এই খাত থেকে যত ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা সরকার করে, তার চেয়ে বিক্রি হয় অনেক বেশি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা বড় হয়, ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যায়। এমনকি অর্থবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ এখন ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের মতো অনিরাপদ জায়গায় টাকা লগ্নি করে বিপদে পড়েছে। মানুষকে আরো নিত্যনতুন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। না হলে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনে তারা সবাই নিম্ন-আয়ের মানুষ নয়। তা ছাড়া সঞ্চয়পত্রে মুনাফা বেশি থাকায় এবং ব্যাংকে ডিপোজিটে সুদের হার কম থাকায় মানুষ ঢালাওভাবে সঞ্চয়পত্র কেনে। আর সরকারের বাজেটে প্রতিবছর যে লক্ষ্যমাত্রা থাকে তার চেয়ে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়। ফলে সরকারের সুদের ব্যয়ভার বেড়ে যায়। এতে সরকারকে অন্য জায়গায় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।’
তাহলে মানুষ কোথায় বিনিয়োগ করবে জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মানুষের বিনিয়োগের ক্ষেত্র যথেষ্ট নেই। সরকারকে নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। ব্যাংক খাতে সুদহার অদূর ভবিষ্যতে বাড়বে বলে মনে হয় না। শেয়ারবাজারের অবস্থা এখন সন্তোষজনক। একটু দেখেশুনে বিনিয়োগ করলে কিছু লাভ পাওয়া যেতে পারে। ভালো কম্পানির ফিক্সড ইনকাম বন্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মহামারির প্রথম দফায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য তেমন কিছু ছিল না। তারা চাকরি হারিয়ে অসহায়ত্বের মধ্যে আছে। নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ার বিষয়টির প্রতিফলন দেখা যায়নি। অন্য দেশে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে আমাদের দেশেও মধ্যবিত্তদের জন্য কিছু কর্মসূচি নেওয়া উচিত।’
বাংলা৭১নিউজ/এবি