বাংলা৭১নিউজ, ডেস্ক: বরাবরের মতো এবারও রোজার শুরুতেই নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে৷ কিন্তু বাজারে এইসব পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন খোদ ব্যবসায়ীরা৷ তারপরও পণ্যের দাম কেন রোজায় বাড়ে?
রোজার কয়েকদিন আগে থেকেই নিত্যপণ্যসহ কাঁচা সবজির বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে৷ একইসঙ্গে দাম বেড়েছে মাছ ও মুরগির মাংসের৷ গরুর মাংসের দাম বেঁধে দেয়া হলেও সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম নিচ্ছেন৷ দাম বেড়েছে ছোলাসহ ডাল জাতীয় ভোগ্যপণ্যের৷ এই পরিস্থিতি চলবে পুরো রমজান মাস জুড়ে৷
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘এবার রমজানে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের কোনো ঘাটতি নেই৷ আমদানী করা এবং দেশে উৎপাদিত পণ্য সবকিছুর সরবরাহ পর্যাপ্ত৷”
তারপরও দাম বাড়ছে কেন রমজানে? শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘রোজার মাসে ভোগ্যপণ্য কেনার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে৷ তিনমাসে যা কেনেননি তা একমাসে কিনছেন সাধারণ মানুষ৷ আমাদের তো পাগল হওয়ার মতো অবস্থা৷ ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই মাসে মানুষ বেশি কিনছেন৷ কেউ পুরো মাসের বাজার একসঙ্গে করছেন৷ কেউ প্রয়োজনের চেয়েও বেশি কিনছেন৷ আবার সাধারণ মাসের চেয়ে রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের ব্যবহারও বেশি হয়৷ এসব কারণে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়ে যায়৷” তবে তাঁর দাবি, এবার পণ্যের দাম খুব বেশি বাড়েনি৷
আর ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি নেসার উদ্দিন জানান, ‘‘এবার নতুন করে ডাল আমদনি করতে হয়নি৷ আমরা গত বছর যে বিভিন্ন ধরনের ডাল আমদানি করেছি তা থেকেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যানজট৷ আমাদের চট্টগ্রাম থেকে ডাল ঢাকায় আনতে হয়৷ রোজার কয়েকদিন আগে থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট শুরু হয়েছে৷ ফলে পরিবহণ খরচ বেড়ে গেছে৷ এ কারণে দামও কিছুটা বেড়েছে৷ তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার রোজায় দাম তেমন বাড়েনি৷”
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা দোকানগুলোয় প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়৷ প্রতি লিটার সয়াবিন ১০৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ আর পাঁচ লিটারের বোতল কোনো কোম্পানি ৫৪০ টাকা, কোনও কোম্পানি ৫৫০ টাকায় বিক্রি করছে৷ প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৮৮ থেকে ৯০ টাকায়৷
রমজানে বেড়েছে মসুর ডাল, কাঁচা মরিচ, শসা, বেগুন ও লেবুর চাহিদা বেড়েছে৷ বৃহস্পতিবার ঢাকার ৪০ টাকার প্রতি কেজি বেগুন ৮০ থেকে ৯০ টাকা, ৩৫-৪০ টাকার কাঁচামরিচ ৯০ থেকে ১০০ টাকা, ২০-২৫ টাকার হালি দরের লেবু ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে৷ মসুর ডাল মুদি দোকানগুলোয় ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেলেও রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করতে দেখা গেছে৷ ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরের দেশি পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে৷
ঢাকার হাতিরপুল সবজি বিক্রেতা রহমত আলী বলেন, ‘‘ রোজার সময় সবাই কম-বেশি বাজার করে৷ এর ফলে এ সময় সব ধরনের পণ্যের চাহিদা বাড়ে৷ আর চাহিদা বাড়লে বাড়ে পণ্যের দাম৷ আমরা সারা বছর যা বিক্রি করি তার বড় একটি অংশ এই রমজান মাসে বিক্রি করি৷ মানুষ কেনেও বেশি৷ আর আমরাও এই সময়েই মূলত ব্যবসা করি৷ এ আর নতুন কী!”
আর শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী আলি হোসেন বলেন,‘‘ক্রেতার হাবভাব দেখে মনে হয়, বাজারে সব পণ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ কিনতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হবে৷ অনেক সময় ক্রেতারা দাম-দর জিজ্ঞেস না করেই অতিরিক্ত পরিমাণ পণ্যের অর্ডার দিতে থাকেন৷ এক কেজির স্থলে দুই কেজি, দুই কেজির স্থলে ৫ কেজি, ৪ কেজির স্থলে ১০ কেজি পণ্য কেনেন৷ এতে বাজারে একটু চাপ পড়ে৷ এ কারণেই অনেক সময় সরবরাহে সমস্যা তৈরি হয়৷ আর এই সুযোগটি গ্রহণ করেন ব্যবসায়ীরা৷”
এদিকে সরকারের নির্দেশ অনুসারে বাজারের প্রবেশমুখে নিত্যপণ্যের দর টানিয়ে রাখার বিধান থাকলেও তা মানছেন না কেউই৷ সিটি কর্পোরেশন গরুর মাংসের দাম ঠিক করে দিয়েছে প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা৷ কিন্তু ৫০০ টাকার নীচে তা পাওয়া যাচ্ছে না৷ ব্রয়লার ও পাকিস্তানি উভয় জাতের মুরগির দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত৷ মুরগি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘‘ এমনিতেই গত শীতে মড়কের কারণে মুরগির উৎপাদন কম৷ আর রোজায় চাহিদা বেড়েছে৷ তাই দামও বাড়তি৷ এক হালি কক মুরগি আগে ছিল ৯ শ’ টাক, এখন ১২শ’ টাকা৷ মাছের দামও বেড়েছে৷
সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের একটি শক্ত সিন্ডিকেট আছে আমাদের দেশে৷ তারা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য শুধু রোজা নয়, বিভিন্ন সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ ফলে অনেক ভোগ্যপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কম হলেও আমাদের এখানে বেশি৷ আর দেশীয় ভোগ্যপণ্যে মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফার জন্য রমাজানে চাহিদার দিকে খেয়াল করে দাম বাড়িয়ে দেয়৷ ভারতে পিঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১২ রুপি আর সেই পিঁয়াজ আমাদের এখানে ৩৫-৪০ টাকা কেজি৷ এটা কিভাবে হয়?”
রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার সামলাতে আছে সরকারের ১১ সংস্থা৷ এই ১১ সংস্থার প্রায় ৩০-৩৫টি টিমের বাজার মনিটর করার কথা৷ কিন্তু ক্রেতাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ঠিকই মুনাফা লুটে নিচ্ছে৷ তাঁরা বলছেনন, এসব সংস্থার নির্দেশ অনেকেই মানছে না৷ কখন কোন সংস্থা কোন নির্দেশ দিচ্ছে, তা কে মানছে আর কে মানছে না, তা তদারকির কেউ নেই৷
বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশন৷ এর বাইরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও জেলা প্রশাসনের প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিং করার কথা৷ একইসঙ্গে বাজারে আগে থেকেই কাজ করছে সরকারের চারটি গোয়েন্দা সংস্থা৷ ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাজারে মূল্য পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ৫টি নিত্যপণ্য মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, চিনি, খেজুর ও ছোলা বিক্রি করছে৷ অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে খোলা বাজারে বিক্রি করছে৷
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘এই মনিটরিং টিমগুলো ঠিকমতো কাজ করছে বলে মনে হয় না৷ বাজারে তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি দরকার৷ আগে আমরা বিক্রেতারা দাম বেশি নেয়ায় তাদের শাস্তির আওতাও আনতে দেখেছি৷ এখন আর সেরকম হচ্ছে না৷ এইসব দৃশ্যমান তৎপরতা অব্যাহত থাকলে অযথা দাম বাড়ানোর প্রবণতা কমবে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘টিসিবি’র মাধ্যমে কিছু পণ্য বাজারে ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে তাতে আসলে কোনো ফল আসবে না৷ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই পণ্যের দাম ঠিক করতে হবে৷ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে৷ আমদানি পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে৷ মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করতে হবে৷”
আর ইসালামি বিশ্লেষক মুফতি নুসরাতুল্লাহ কাশেমি বলেন, ‘‘পুঁজিবাদী মানসিকতার কারণে একটি গোষ্ঠী রোজার মাসে মানুষকে জিম্মি করে, সিন্ডিকেট করে অতিরিক্তি মুনাফা আদায়ের চেষ্টা করে৷ আমরা এটা অনেক দিন ধরেই দেখে আসছি৷ কিন্তু ইসলাম এই সিন্ডিকেট ও পণ্য জমা করে দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে বলেছে৷ মুসলমান হিসেবে আমাদের এই মানসিকতা পরিত্যাগ করা উচিত৷”
বাংলা৭১নিউজ/তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে্/এসএস