উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে তিস্তাসহ গাইবান্ধার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত দুই দিনে বৃষ্টিপাত তেমন না হওয়ায় জেলার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। এরমধ্যে সুন্দরগঞ্জে (কাউনিয়া পয়েন্টে) তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবার (২৪ জুন) দুপুর ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সব নদ-নদীর পানির উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, কাপাসিয়া, হরিপুর ও বেলকা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে কাপাসিয়া ইউনিয়নের দুই শতাধিক পরিবার। সেখানকার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, আমনের বীজতলা ও সবজিক্ষেত তলিয়ে যায়। বর্তমানে পানি কমায় এসব এলাকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
কাপাসিয়া ইউনিয়নের উজান বুরাইল গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ আলী বলেন, ‘যেভাবে পানি বেড়েছিল, তাতে মনে হয়েছে, দুই একদিনের মধ্যে ঘরে পানি উঠবে। নৌকা ছাড়া বাহিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। ঘর থেকে বের হতে পারছিলাম না। গরু-ছাগল নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছিলাম। দুদিন ধরে আমরা ২০ থেকে ২৫টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে উঁচু আশ্রয়ন কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছি। বহুবার ঘরবাড়ি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পানি কিছুটা কমেছে। পানি আর না বাড়লে শীঘ্রই বাড়ি ফিরে যাব।’
একই ইউনিয়নের কাজিয়ার চরের পানিবন্দি আরেক বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, ‘হঠাৎ ঢলের পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। চারপাশে পানি উঠে ক্ষেত-খামার ডুবে আছে। পানি একেবারে কমে যাওয়ার আশায় আছি।’
কাজিয়ার চরের বাসিন্দা হবিবর রহমান বলেন, ‘ঢলের পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এতে আমরা ভোগান্তিতে পড়েছি। গতকাল থেকে পানি কিছুটা কমেছে।’
কাপাসিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজু মিয়া বলেন, যেভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, তাতে আগামী দু-চারদিনের মধ্যে ঘরে ঘরে পানি প্রবেশ করে চরাঞ্চলের হাজারও মানুষ ঘর ছাড়া হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিবছর অনেক ঘরবাড়ি নদীর তীব্র স্রোতে ভেঙে যায়। এসব মানুষ তখন জীবন ও জীবিকার টানে অন্যত্র চলে যায়। এই ইউনিয়নের দুই শতাধিক পরিবার এখনও পানিবন্দি হয়ে আছে। তাদের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবারসহ নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গার চরের বাসিন্দা সোহরাব মিয়া বলেন, ‘নিচু চরে পানি ঢুকেছে। এখনও অনেক চরে পাটের আবাদ রয়েছে। যদিও বাদাম ও মরিচ মাড়াই শেষ হয়েছে। গত বছর বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। এবার যদি ভেঙে যায়, একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।’
এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্ত তরিকুল ইসলাম জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবধরনের প্রস্তুতি হাতে নেওয়া হয়েছে। সুন্দরগঞ্জের তিনটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কয়েকশত মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
এছাড়া গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের বেশ কিছু স্থান প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর ও ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি, ফুলছড়ি ও ফজলুপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তবে, নদীতে পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র স্রোতে সদর উপজেলার মোল্লারচর ও ফুলছড়ির ফজলুপুর ইউনিয়নের কিছু স্থানে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।
মোল্লারচর ইউনিয়নের সিদাই গ্রামের বাসিন্দা আজহার আলী বলেন, ‘বাড়ির চারপাশে পানি উঠেছে। পাঁচ বছর আগে ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। এবারও ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতোমধ্যে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তবে, পানি কিছুটা কমেছে।’
কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাহালম মিয়া জানান, এর আগে পাঁচ-ছয়বার ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। জমি-জমা সব শেষ। এক শতক জমিও আর অবশিষ্ট নেই। বড় বন্যা হলে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবেন তারা।
সোমবার (২৪ জুন) গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোলরুম সূত্রে জানা যায়, দুপুর ৩টা পর্যন্ত তিস্তার পানি (কাউনিয়া পয়েন্টে) বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি (ফুলছড়ি পয়েন্টে) ১৩৭ সে.মি, ঘাঘট নদীর পানি (নতুন ব্রিজ পয়েন্টে) ১৬৫ সে.মি ও করতোয়া নদীর পানি (চকরহিমাপুর পয়েন্টে) বিপৎসীমার ১৪০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ আল হাসান বলেন, জেলা ও উপজেলায় দুর্যোগকালীন সভা করা হচ্ছে। সদর উপজেলার নদী বেষ্টিত চারটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ বন্যা সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশ অনুযায়ী, তারা নদীর তীরবর্তী যেসব ওয়ার্ড রয়েছে সেসব এলাকা গ্রুপভিত্তিক স্বেছাসেবীদের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখবে। এছাড়া পানিবন্দি এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণসহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে’।
জেলা প্রশাসক কাজি নাহিদ রসুল বলেন, সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া ও হরিপুরে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া পরিবারের মাঝে ঢেউটিন এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ