সাখাওয়াত হোসেন বাদশা: রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।কিন্ত কী এমন ক্ষতি ছিল-যে সংলাপটি এখন হচ্ছে, সেটি যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হতো? কারা সেদিন এই সংলাপ হতে দেয়নি? বরং রাজনীতিকে করে তুলেছিল নোংরা? এমন প্রশ্ন এখন সারা বাংলা জুড়ে।
সেসময় বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার আণ্টিমেটামের পরিপ্রেক্ষিতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ফোন করেছিলেন। অথচ ওপর প্রান্ত থেকে বেগম খালেদা জিয়া এই ফোনের ইতিবাচক সুফল নিতে পারেননি, কিম্বা কারা তাকে নিতে দেননি- তার উত্তর আজও দেশবাসীর কাছে অজানা।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে টানটান উত্তেজনার মাঝে সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। দিয়েছিলেন নৈশভোজের দাওয়াত। সেদিন যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত ওই সংলাপটি হতো, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষপট রচিত হতো পারতো ভিন্নভাবে। সৌহার্দ্য ও সম্প্রতিতির সুবাতাশ বইতে পারতো গণতন্ত্রের বাতায়নে। কিন্ত তা হয়নি।
যার পরিণতি ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস। আর তারেক রহমান স্বপরিবারে লন্ডন প্রবাসী। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় বর্তমানে তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামীর তালিকাতেও রয়েছেন।
মেঘে মেঘে এখন অনেক বেলা। সেদিনের সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টেছে। বোধদয় হয়েছে বিএনপি নেতাদের মাঝেও।কিন্ত সময়ের বিবরতনে দলটির সাংগঠনিক গতি এখন মন্থর। নেতা-কর্মী মামলা, হামলায় ঘর ছাড়া। আদালতে হাজিরা দি্তেই সময় পার।
তদুপরি, বিএনপিতে বাসা বেঁধেছে নানা ধরণের কোন্দ্বল- উপকোন্দ্বল। এমন প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপিকে আজ চিঠি দিয়ে সেদিনের সেই প্রধানমন্ত্রীরই (শেখ হাসিনা) নিমন্ত্রন গ্রহণ করতে হয়েছে। বসতে হয়েছে গণভবণে শেখ হাসিনার সাথেই। নেতৃত্বে ছিলেন গনফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন। আর তার পাশে ছিলেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাজনীতিতে ভুল করলে যে খেশারত দিতে হয়-তা এখন বেগম খালেদা জিয়ার চেয়ে ভাল আর কেউ অনুধাবন করছেন না। নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগার থেকে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রয়েছেন। তিনি যে রুমটিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেটিই এখন কারাকক্ষ।
অথচ এখান থেকে গণভবণের দূরত্ব মাত্র আড়াই কিলোমিটার। ১লা নভেম্বর সেখানেই বসেছিল ড. কামালের নেতৃত্বে তার (খালেদা জিয়া) দলের নেতারা। শেখ হাসিনা সাথে সংলাপ করেছেন, নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন, চেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। জবাবও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি কিম্বা তার সরকার মামলা দেননি। দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর রায় দিয়েছে আদালত। ফলে এখানে তার কিছুই করার নেই।
অথচ ইতিহাস আজ অন্যরকম হতে পারতো, যদি সংলাপে সাড়া দিয়ে সেদিন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। ওই বৈঠক শেষে যদি দুই নেত্রীর নৈশভোজের চিত্র গোটা দেশবাসী দেখতো। তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তো আরও একটি সোনালী দিনের গল্প লিপিবদ্ধ থাকতো।
ফিরে দেখা:
২৬শে অক্টোবর ২০১৩।ফোনে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেত্রীকে সোমবার গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দেন।সে সময় হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
শেখ হাসিনার প্রেস উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ওই সময় সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেত্রীকে বলেন, তার বেঁধে দেওয়া দুদিনের সময়সীমার মধ্যেই তিনি আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছেন, সুতরাং হরতালের এখন তো প্রয়োজন নেই।
হরতাল প্রত্যাহার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান মিডিয়াকে বলেন, বিরোধী নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বলেন এটা যেহেতু ১৮ দলের কর্মসূচী, সে কারণে শেষ মুহূর্তে জোটের নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেই। খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে তার প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘সংলাপ এবং আন্দোলন একসাথে চালিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই।’
শেখ হাসিনার সোমবারের নৈশভোজের দাওয়াত প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচীর সময় তিনি বেরুতে পারবেন না। কিন্তু তারপর যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে প্রস্তুত।
ওই দিন সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন এবং প্রায় ৪০ মিনিট ধরে এই দুই নেত্রীর মধ্যে কথা হয়।
প্রথমেই শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করেন দুপুরে তার ফোন কেন ধরেননি খালেদা জিয়া। উত্তরে বিরোধী নেত্রী বলেন, তার লাল ফোন অনেক দিন ধরেই বিকল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা তার জানা ছিলনা।
এই দুই নেত্রীর মধ্যে শেষবার কথা হয়েছিল ২০০৯ সালের ৯ই মে। প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার বাড়িতে গিয়েছিলেন সেদিন।
টেলিফোন নিয়ে নাটকীয়তা:
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করার আগেই ওইসময়কার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু (বর্তমানেও তথ্যমন্ত্রী) ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ‘প্রধানমন্ত্রী শনিবার বিরোধী নেত্রীকে ফোন করবেন’।
রাজনীতি তখন এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, ওই রকম বৈরি পরিস্থিতিতে সেই বিরল ঘটনাটি ঘটবে কিনা তা নিয়ে পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিকদের মধ্যে সন্দেহ ছিল।
দুপুরের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিশ্চিত করা হয় শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রীর লাল টেলিফোনে বার দুয়েক ফোন করেও সাড়া পান নি।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি