বাংলা৭১নিউজ,(রংপুর)প্রতিনিধি: শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলে চালের বাজার ফের অস্থির হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরে বাজারে চালের দাম বেড়েছে। মান ও প্রকারভেদে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রতিবস্তায় (৫০ কেজি) ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাইস মিল মালিক ও মজুদদারদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণের কারণে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এজন্য উত্তরবঙ্গের রাইস মিল মালিক ও চালের করপোরেট কম্পানিগুলোকে দায়ী করছেন তাঁরা।
অন্যদিকে, চলতি বছর উত্তরাঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৫৫ লাখ মেট্রিকটন ধান উদ্বৃত্ত হলেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গত আমন মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিকটন আমন ধান উপাদিত হয়েছে। প্রত্যেক ফসল ওঠার মৌসুমে একটি সিন্ডিকেট মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের থেকে কম দামে খাদ্যশস্য কিনে মজুদের পাহাড় গড়ে মুনাফা লুটছে। সরকার মজুদবিরোধী অভিযানের ঘোষনা দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উত্তরের ১৬ জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২৭ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৪ হেক্টর। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৬৪ হেক্টর এবং রাজশাহী বিভাগে ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৯০ হেক্টর। উত্তরাঞ্চলে মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ১১ শতাংশ রয়েছে শিশু ও বৃদ্ধ এবং খাদ্য গ্রহণে অনুপযোগি। এই ১১ শতাংশ বাদ দিলে উত্তরাঞ্চলে খাদ্য গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা তিন কোটির ওপরে।
একজন মানুষ প্রতিদিন ৫৫৩ দশমিক ০৬ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সেই হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের প্রতিবছর খাদ্যের চাহিদা ৫৮ লাখ ২ হাজার ১১ মেট্রিকটন। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে খাদ্য চাহিদা ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ৪১১ মেট্রিকটন এবং রাজশাহী বিভাগে ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ মেট্রিকটন।
চলতি বছর আমন, আউশ ও বোরো ফসলের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ২২ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৪ মেট্রিকটন। মোট উৎপাদন থেকে চাহিদা বাদ দিলে এক বছরে এ অঞ্চলে খাদ্যের উদ্বৃত্ত থাকছে ৫৫ লাখ ৮০ হাজার ৭১০ মেট্রিকটন। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে উদ্বৃত্ত ২৬ লাখ ১৫ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন এবং রাজশাহী বিভাগে উদ্বৃত্ত ২৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৪৫ মেটিকটন। এই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
কৃষিবিদদের মতে, দেশের কৃষিভিক্তিক অর্থনীতিতে উত্তরাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এ অঞ্চলের কৃষকরা প্রতিটি ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফসল ওঠার শুরুতেই এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী গ্রাম-গঞ্জের হাট বাজারে নেমে পড়ে। তারা ঘাম ঝড়ানো ফসল কৃষকদের কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করে। এ ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। অনেক ক্ষেত্রে এরা কৃষককে আগাম টাকা ঋণ দেয়। ঋণ পরিশোধে কৃষক বাধ্য হয় কম দামে ফসল বিক্রি করতে।
প্রতিমৌসুমে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০০ আটো রাইসমিল মালিক ধানের মজুদ গড়ে তোলার লক্ষে দালাল ফরিয়া নিযোগ করে। মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া মজুদদার ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ধানের মৌসুমে কোমড় বেঁধে মাঠে নামে। পরে মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামে এখন প্রতিমণ ধান ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ধানের দামের তুলনায় চালের দাম কমেনি। বরং দফায় দফায় বাড়ছে চালের দাম। সর্বশেষ করোনাভাইরাসের কারণে চাহিদা বাড়ায় চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
রংপুরের বিভিন্ন আড়ত থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এক সপ্তাহ আগে এখানে জিরাশাইল চাল বিক্রি হয়েছিল বস্তাপ্রতি দুই হাজার ১০০ টাকায়। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া মিনিকেট বস্তাপ্রতি ২৫০ টাকা বেড়ে দুই হাজার টাকা, স্বর্ণা ৩০০ টাকা বেড়ে এক হাজার ৭৮০ টাকা, মোটা স্বর্ণা ২৫০ টাকা বেড়ে এক হাজার ৫০০ টাকা, বাসমতি ৩০০ টাকা বেড়ে বস্তাপ্রতি দুই হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে মজুদ করে করোনার অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
মিল চাতাল মালিক, চাল ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকদের অভিযোগ, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০০ অটোরাইস মিল মালিক নিজেদের ইচ্ছেমত মজুদের পাহাড় গড়ে তুলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। অটোরাইস মিলগুলো লাখ লাখ মণ ধানের মজুদ করে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালের দাম নির্ধারণ করছেন।
আশঙ্কা প্রকাশ করে সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমনিতে মানুষ রয়েছে করোনা আতঙ্কে। তার ওপর চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁরা। সরকার এখনই যদি এই অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে সিন্ডিকেটটি চালের বাজার অস্থিতিশিল করে তুলবে।
রংপুরের মাহিগঞ্জসহ দিনাজপুরের পুলহাট, বগুড়া, নওগাঁ ও রাজশাহী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এসব মোকামে এক সপ্তাহ আগেই অটোরাইস মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
রংপুরের আবু পাটোয়ারী, রহিম পাঠান, মহিদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন আড়তদার জানান, তারা বিভিন্ন মোকাম ঘুরেও অটোরাইস মিলগুলোর কারণে চাল সংগ্রহ করতে পারেননি। অটোরাইস মিলের মালিকরা বাজার থেকে এক তরফাভাবে ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছেমত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা জানান, পুরো উত্তরাঞ্চলের হাতে গোনা ৫০০ থেকে ৬০০ জন বড় ব্যবসায়ী ও অটোরাইস মিল মালিক সারা দেশের চালের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে তারা তাদের মিল চাতাল বন্ধ করে দিয়েছেন।
ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলগেইটে চালের দাম বেড়েছে প্রতিবস্তায় প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। আবার আগের তুলনায় এখন কম সরবরাহ করছেন চালকল মালিকরা। ফলে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে খুচরা পর্যায়ে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে মিল মালিক ও আড়তদাররা বলছেন, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ এবারে কিছুটা গতি পাওয়ায় কৃষক পর্যায়েই ধানের দাম বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের দাম বেড়েছে মণপ্রতি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এর ধারাবাহিকতায় দেশের বড় মোকাম ও মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এখন এরই প্রভাব পড়েছে খুচরা ও পাইকারি বাজারে।
রংপুর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম চালের দাম বৃদ্ধির জন্য সরাসরি অটোরাইস মিলগুলোকে দায়ী করে বলেন, অটো রাইসমিল মালিকরা আগে থেকে ধানের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে অটোরাইস মিলগুলোর সাথে পাল্লা দিতে না পেরে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা অসহায় হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, মোটা, চিকনসহ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, অটোরাইস মিলগুলো মজুদের পাশাপাশি করোনাভাইরাসকে ঘিরে চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়া।
বাংলা৭১নিউজ/এমএস