বেঙ্গালুরের ইংরেজি খবরের কাগজ ডেকান হেরাল্ড ১৯৮৬ সালের ৭ ডিসেম্বর তাদের সানডে এডিশনে একটি গল্প ছাপে। শিরোনাম ছিল Mohammad the Idiot। শিরোনামটি নিঃসন্দেহে ভুল ছিল। কিন্তু এর জবাবে মুসলমানরা যা করেছেন তাও একেবারেই ভুল কাজ। তারা শিরোনাম দেখে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেন। পত্রিকা অফিসে হামলা করে বসলেন। তাদের গোডাউনে আগুন দিলেন। এক কোটি রুপি মূল্যের কাগজ পুড়ে ছাই। মুসলমানরা তাদের এ কাজকে ‘ইসলামি জিহাদ’ নাম দিলেন। একেতো ভুল কাজ তার উপর আবার ঔদ্ধত্য। এ ধরনের কাজ সাম্প্রদায়িক উগ্রতা স্রেফ। এটি সে পবিত্র আমল নয়, যাকে কুরআন-হাদিসে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বলা হয়েছে।
পত্রিকাটি যে অনর্থক কাজটি করেছে ইসলামের ইতিহাসে এটি নতুন কিছু না। জগতে প্রতিটি মানুষকেই পরীক্ষার জন্য আল্লাহ স্বাধীনতা দিয়েছেন। খোদ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জীবিত তখনো এমনটা ঘটেছে। ইতিহাস বলে, মহানবী যখন আরবদের কাছে নবুয়াতের আহ্বান জানান তখন তারা অত্যন্ত খারাপ আচরণ করে। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা ছাড়াও তাঁকে নানা উপাধি দেয়। যেমন— মুতাকাউয়িল (যে বানিয়ে কথা বলে), সাহির (যাদুকর), মাজনুন (পাগল), কাজ্জাব (মিথ্যুক)।
মুসলমানরা জিহাদ করতে চাইলে তাদের প্রথম কাজ হত- রসুল ও সাহাবাগণ এমন পরিস্থিতিতে কী করতেন তার খোঁজ নেয়া। তারপর তাই করত মহানবী, সাহাবা ও ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা যা করে গেছেন। সিরাত আর সাহাবিদের ছেড়ে এসব দাঙ্গাবাজি করা নিজের রিপুর পূজা, খোদার পূজা নয়। নয় রসুলের অনুসরণও।
ইসলামের প্রথম যুগের দিকে তাকালে দেখি, রসুলকে নিয়ে এমন অভদ্রোচিত কাজ করা অমুসলিমদের ব্যাপারে কখনো এমনটি করা হয় নি যেমনটি বর্তমান মুসলমানেরা করেছেন বা করছেন। সাহাবিগণ এ নিয়ে মিছিল করেননি, কারো বাড়িঘরে আগুন দেননি। কারো বিরুদ্ধে উত্তেজক স্লোগানও দেননি। যা করেছেন তা হল- দু’আ। তাদের হেদায়েতের দু’আ। যুক্তি প্রমাণের মধ্যমে তাদের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। বাকিটা ছেড়ে দিয়েছেন আল্লাহর উপর।
রসুল ও সাহাবিদের দৃষ্টান্ত আমাদের করণীয় বলে দেয়। আমরা এসব লোকদের সংশোধন ও হেদায়েতের জন্য শুধুই দু’আ করতে পারি। তাদের সঙ্গে দেখা করে ভুল বোঝাবুঝির নিরসন করতে পারি। যৌক্তিক ও প্রামাণ্য লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারি। মুসলমানদের করণীয় এই একটাই কাজ। এ ছাড়া যা-ই করছে তা রহমতকে নয়, খোদায়ী গজবকে ডেকে আনবে। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীকে রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছেন, জ্বালাও-পোড়াওকারী হিসেবে নয়।
বর্তমান মুসলমানদের এই বদমেজাজের কারণে সবচেয়ে’ বড় নেয়ামতটি তারা হারিয়েছে। দা’য়ীর (ইসলামের দিকে আহ্বানকারী) ভাষার কার্যকারিতা তারা হারিয়েছে। দা’য়ী স্বসম্প্রদায়ের শুভাকাঙ্ক্ষী হোন। শ্রুতার প্রতি ভালোবাসা আর শুভাকাঙ্ক্ষা দা’য়ীর মুখ দিয়ে বেরোয়। কিন্তু কথায় কথায় চটে যাওয়ার যে বদভ্যাস হয়েছে তা ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা আর অপ্রসন্নতার প্রকাশ। কোমল ও দালিলিক ভাষায় কাউকে যে আল্লাহর রসুলের দুটো কথা শুনাবে সে মানসিকতাই এদের মধ্যে বেঁচে নেই।
রসুলকে নিয়ে মিছিলের ধূমধাম সত্ত্বেও রসুলের আহ্বান থমকে পড়ে থাকার এটাই একমাত্র কারণ। মহানবীর পর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কাজ ছিল খোদার দিকে তাঁর বান্দাদের আহ্বান করা। এ কাজের জন্য মানুষের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসার প্রয়োজন। আর এরা নেতিবাচক মনোভাবের কারণে সে ভালোবাসাটাই খুইয়ে বসে আছে।
লেখক: ওয়াহিদুদ্দীন খান
[মাওলানা ওয়াহিদুদ্দীন খান একজন ইসলামিক স্কলার এবং শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় ব্যক্তিত্ব। এ পর্যন্ত তিনি তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছ, ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মভূষণ ও রাজীবগান্ধী পুরস্কার। শান্তির জন্য পেয়েছেন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ পুরস্কারসহ আরও বহু পুরস্কার।
ইসলাম তলোয়ারে নয়, উদারতায় এসেছে—যেন এর প্রমাণ দিতে অনবরত লিখে চলেছেন ওয়াহিদুদ্দীন খান। এখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ, তবু অক্লান্ত পরিশ্রমী। তিনি তার কাজের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিসকোর্স হাজির করেছেন। বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তিনি অতটা পরিচিত নন। তবে তার চিন্তাধারা ইসলামী স্কলারদের ছাড়াও এখানকার প্রগতিশীল লোকজনের সুকুমার ভাবনার খোরাক জোগাবে বলে বিশ্বাস করা যায়।
তাঁর তুমুল আলোচিত একটি বই ‘শাতমে রসুল কা মাসআলা’ ।