মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরা : কথিত ইরানি জিরা আবাদ করে মাথায় হাত পড়েছে মাগুরার কৃষকের। বেশি লাভের আশায় দামি মশলার নামে ‘সলুক’ চাষ করে পথে বসেছেন জেলার সহস্রাধিক কৃষক। জেলার আঞ্চলিক মশলা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন আবাদ করা মশলা আদৌ ‘জিরা’ নয়।
জিরা প্রজাতির আগাছা জাতীয় এই মশলাটি ‘সলুক’ নামে পরিচিত। ভেষজ ইউনানি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হলেও এর চাহিদা ও বাজার মূল্য নেই বললেই চলে। কোন অবস্থাতেই সলুক জিরার বিকল্প ও রান্নার উপযোগি নয়। ভালো ফলন হলেও এই ফসল কৃষকের কোন কাজে আসছে না। এতে কৃষকেরা চরম ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন।
সরেজমিন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবেশি নড়াইল সদরের নাজমুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ইরানের জিরা উৎপাদন কৃষি খামার থেকে গোপনে দেশে বীজ আনেন বলে কৃষকদের মধ্যে প্রচার করেন। কথিত ইরানি জিরার ২৫০ গ্রাম বীজ ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দামে বিক্রি করেন। কৃষকদের লোভ দেখানো হয় এই বীজ থেকে ১০ লাখ টাকার জিরা বীজ উৎপাদন করে বিক্রি করা যাবে।
মাগুরা সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখার প্রায় এক হাজার কৃষক জিরার নামে সলুক মশলার বীজ অতি যত্নে বপণ করে পরিচর্যা করতে থাকেন। নতুন এই ফসলের খবর পৌঁছে যায় সর্বত্র। জিরা ফসল দেখতে খেতের আইলে ভিড় করেন উৎসুক লোকজন। কৃষক-কৃষি বিভাগ সবাই মহা খুশি। খবর পৌঁছে যায় মাগুরা আঞ্চলিক মশলা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের কাছে। দেখা গেছে, কথিত জিরার গাছের উচ্চতা ৪ থেকে ৫ ফুট। ঘন কাণ্ডের মাথায় বড় গুচ্ছে হলুদ ফুল। ফল পরিপক্ক হওয়ার সময় গোমর ফাঁস হয়ে পড়ে। এর দানা জিরার চেয়ে অনেক বড় এমনকি পান মশলা মৌরির চেয়েও বড়। অনেকটা গমের মতো দ্বীবীজপত্রি, মাঝখান দিয়ে দুটি অংশ জোড়া লাগানো। কৃষক ও কৃষি বিভাগ নিশ্চিত হন মাঠের এই ফসল কোন অবস্থাতেই জিরা নয়।
রবিশস্যের মৌসুমে কৃষকেরা মুগ, মসুর ডাল, মরিচ, গম খেসারী, তিল, তিসি, সরিষা, বাদাম ও সবজি চাষ বাদ দিয়ে কথিত জিরার আবাদ করে চরম ক্ষতির সম্মুখিন হন এসব কৃষক।
মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়ার মাঠপাড়া গ্রামের কৃষক আকতারুজ্জামান মৃধা ২১ শতাংশ জমিতে, পলাশবাড়ীয়া ইউনিয়নের কালিশংকরপুর গ্রামের চাষি চান্দু মোল্যা ১৫ শতাংশ জমিতে, নহাটা ইউনিয়নের খলিশাখালির তৈয়োব বিশ্বাস ৩ শতাংশ জমিতে, রামদেব পুরের ডাঃ খবির হোসেন ও একই গ্রামের মতিয়ার মোল্যা ১২ শতাংশ জমিতে , সালধা গ্রামের অসিম গয়ালী ৬ শতাংশ জমিতে ও হরিয়াখালী গ্রামের মশিয়ার ১২শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে জিরার চাষ করেন। বেশি লাভের আশায় গড়ে দুই লাখ টাকা খরচ করে পথে বসেছেন এসব কৃষক।
কৃষক আক্তারুজ্জামান মৃধা জানান, নড়াইল থেকে ৩০০ গ্রাম ইরানি জিরার বীজ ৬ হাজার টাকায় কিনে ২১ শতাংশ জমিতে বপণ করেন তিনি। সব মিলে আবাদের পিছনে এক লাখ টাকার বেশি খরচ করেছেন। ভালো ফলন হলেও এর কোন চাহিদা বা বিক্রয় মূল্য নেই। তার মতো কয়েক হাজার কৃষকের অবস্থা এখন এমনই।
মহম্মদপুর কৃষি অফিসের উপসহকারি কৃষিকর্মকর্তা মো: শহীদুল ইসলাম জানান, ‘কৃষকেরা ব্যাক্তি উদ্যেগে বীজ সংগ্রহ করে কথিত জিরার আবাদ করে প্রতারিত হয়েছেন। নতুন করে কোন কৃষক যাতে আর প্রতারিত না হন সে জন্য আমরা সচেতন করছি।’
মাগুরা মশলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, ‘আমাদের দেশের মাটি জিরা চাষের উপযোগী নয়। প্রকৃত জিরার ফুল সাদা ও সবুজাভ। গাছের উচ্চতা সর্বোচ্চ দুই ফুট। জিরার নামে আবাদকৃত আগাছা মশলা সলুকের ফুল হলুদ ও গাছের উচ্চতা পাঁচ থেকে ফুট।’
কৃষকদের সরলতার সুযোগে জিরার বীজ বলে এক শ্রেণির প্রতারক অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান তিনি ।