বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, নির্বাচন সঠিকভাবে হয়নি, তা বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টের আগেই আমি সংসদে বলেছি। নির্বাচন ইস্যুতে খবরের কাগজে নিবন্ধও লিখেছি। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দলের কিছু লোক কথা বলে না। তাই, দীর্ঘদিন ধরেই দল হিসেবে আমরা সংসদে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কারণ, সরকার আমাদের দলের মাঝে একটা বিভেদ তৈরী করার চেষ্টা করছে। সরকারের এটা করা উচিত না। আমাদের মতো দল ধ্বংস হয়ে গেলে সরকারও সুখে থাকবে না।
মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় মিলনায়তনে মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, দেশের সকল ক্ষমতা যদি জনগণের হয়, তাহলে তারাই নির্বাচন করবে জনপ্রতিনিধি। দেশের মানুষের কি ভোটাধিকার আছে? আমরা বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজ চেয়েছিলাম, যেখানে সবার জবাবদিহিতা থাকবে। কেন জিনিসপত্রের দাম কমছে না? কেন প্রতিদিনের লাগা আগুন বন্ধ করতে পারছে না? কেন ভেজাল বন্ধ করতে পারছে না? কারণ হচ্ছে, কোথাও জাবাবদিহিতা নেই। গণতন্ত্রের বড় অবদান হচ্ছে, আইনের চোখে সবাই সমান হবে।
তিনি বলেন, এখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। আইন করা আছে, সরকারের সমালোচনা করলেই আইনমাফিক মামলা হয়। বৈধভাবেই আমাদের দাবিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে সরকার। এটা কোনো স্বাধীন দেশে হতে পারে? মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাঙ্ক্ষিত সমাজ নির্মাণ হয়নি এবং আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমরা উল্টো পথে চলছি।
‘মানুষকে নেতা নির্বাচনের অধিকার দিতে হবে, দেশ পরিচালনায় জবাবদিহিতা থাকতে হবে। ৫ টাকার পণ্য ৫ হাজার টাকায় কেনার মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি চলছে, এগুলো দেখিয়ে বলা হচ্ছে, আমরা গরিব দেশ নই। অল্প সংখ্যক মানুষের জন্য দেশ গরির নয়, দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য বাংলাদেশ গরিব।’
জিএম কাদের অভিযোগ করেন, বেশিরভাগ মানুষই অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ জানে না, কাল তার বাড়িটি দখল হয়ে গেলে বিচারের জন্য কার কাছে যাবে। এমন অসংখ্য অভিযোগ আমরা জানতে পারছি।
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, স্বাধীনতার গুণগান আমরা করব, যে স্বাধীনতার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। সেই স্বাধীনতার জন্য আমরা এগিয়ে যাবো, বাধা এলে মোকবাবিলা করব। যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা গেলে বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, যেখানে যুক্তির দাম নেই, আপসকামীতাকে দুর্বলতা মনে করা হয়, ছোট মনে করা হয়, সেখানে বিপ্লবের বিকল্প হয় না।
‘যে প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনীতি চলছে, তাতে দেশের কোনো আদর্শিক রাজনৈতিক দল টিকবে না। এতে যৌক্তিক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। শুধু সরকার হিসেবেই আওয়ামী লীগ ঠিক আছে।
কিন্তু, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে চরিত্র হওয়ার কথা, তা থেকে তারা দূরে সরে গেছে। সামনের দিকে পাপেট ছাড়া রাজনৈতিক দল থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে, বলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কয়েক গুণ বেড়েছে, অভিযোগ করে জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গ্রামে গ্রামে লোক পাঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা করেছিলেন। সেই তালিকায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেছে। এখন সেই তালিকা কয়েক গুণ বড় হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের লোকের নাম ঢুকাতেই নতুন করে বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যাকে ইচ্ছে তাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে তালিকা মানে, নতুন আরো কিছু লোক ঢোকানো হবে। দেশে নাকি পঞ্চাশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা আছে।
এখন ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, উল্লেখ করে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, কিছু মানুষকে ওপরে তুলে ধরা হচ্ছে, আর কিছু মানুষকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। ইতিহাস বিকৃত করে তা ধরে রাখতে আবার আইন করা হচ্ছে। স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য ছিল—বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমাদের সাথে বৈষম্য করেছিল।
আমরা সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। ভাষার মাধ্যমে আমাদের সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছিল, তার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন হয়েছে। বৈষম্য লালন ও বিভক্তি সৃষ্টি করে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে লুটপাট চলছে। তাই, শহিদ মিনারে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হবে বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও ইংরেজিতে সব কাজ হতো। এতে গ্রামের সাধারণ ছেলেরা চাকরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। কারণ, গ্রামের ছেলেরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারত না। কিন্তু, বড় লোকের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলেরা চাকরি পেতো। তাই, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সকল স্তরে বাংলাভাষা প্রচলনে আইন করেন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়ন করেছিলেন।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপির সভাপতিত্বে ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অংশ নেন—প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম, অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, নাজমা আখতার, শেরীফা কাদের, ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব সুলতান আহমেদ সেলিম, জাতীয় যুব সংহতির সাধারণ সম্পাদক আহাদ ইউ চৌধুরী শাহিন, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. বেলাল হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ সোবহান, জাতীয় কৃষক পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবিএম লিয়াকত হোসেন চাকলাদার, জাতীয় ছাত্র সমাজের সভাপতি আল মামুন।
উপস্থিত ছিলেন—চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার মনির আহমেদ, মো. খলিলুর রহমান খলিল, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মো. হেলাল উদ্দিন, আনিস উর রহমান খোকন, কাজী আবুল খায়ের, সুলতান মাহমুদ, মাসুদুর রহমান মাসুম, এম এ রাজ্জাক খান, জহিরুল ইসলাম মিন্টু, মিজানুর রহমান মিরু, ইঞ্জিনিয়ার এলাহান উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদক আব্দুস সাত্তার গালিব, বাহাদুর ইসলাম ইমতিয়াজ, অ্যাডভোকেট আবু তৈয়ব, মাহমুদ আলম, সমরেশ মন্ডল মানিক, দ্বীন ইসলাম শেখ, কেন্দ্রীয় নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ, জামাল উদ্দিন, মোতাহার হোসেন, পারুল বেগম, আব্দুল কুদ্দুস মানিক, মো. আলমগীর হোসেন, মাহফুজ মোল্লা, রাজ মোহাম্মদ ওমর, অ্যাডভোকেট আলতাফ মন্ডল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে আশরাফুল ইসলাম খান, মো. আব্দুর রহিম, ইঞ্জিনিয়ার জুবায়ের, নাজমুল হাসান রেজা, ওমর ফারুক সুজন, চম্পা মন্ডল, আলাল মেম্বার, মারজান, এরশাদ উল্লাহ প্রমুখ।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ