বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আশপাশে প্রাইভেট কার নিয়ে ওতপেতে থাকে ৩ থেকে ৪ জন। আরেকজন সাধারণ গ্রাহকের মতো ঢুকে পড়ে ভেতরে। ক্যাশ কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে নেয় কে কত টাকা তুলছেন। কেউ বেশি টাকা তুললেই টার্গেট করে তাকে।
প্রায়ই এদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন মানুষ। মাঝেমধ্যে চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে। এ চক্রের সদস্যরা রাতেও নানা বাহানায় লোকজনকে মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারে তুলে নিয়ে ছিনতাই করে।
৬ মার্চ বেলা ১১টা। ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, নিকুঞ্জ-২ শাখায় টাকা তুলতে যান ফেন্সি ফ্যাশন অ্যান্ড এক্সেসরিজের ম্যানেজার মো. সোহেল। ব্যাংক থেকে তিনি দেড় লাখ টাকা তুলে বের হয়ে দুই নম্বর রোডের গ্রাম বাংলা রেস্টুরেন্টের কাছে পৌঁছতেই ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তার পথরোধ করা হয়।
মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ইসলামী ব্যাংক ও আশপাশের এলাকায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, নীল রঙের শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরা এক তরুণ ৬ মার্চ বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ইসলামী ব্যাংকে ঢোকে। তখন ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরী গেটের সামনেই দাঁড়ানো ছিলেন। পরে নীল শার্ট পরা ওই তরুণকে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা
তুলতে যাওয়া গ্রাহকদের পেছনে দাঁড়িয়ে ফলো করতে দেখা যায়। সোহেল দেড় লাখ টাকা তুলে বের হওয়ার আগেই ব্যাংক থেকে বেরিয়ে পড়ে সেই তরুণ। এরপর সহযোগীদের ফোন করে।
গ্রাম বাংলা হোটেলের পাশের এলাকার আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এতে দেখা গেছে, সোহেলকে আটক করে একটি প্রাইভেট কারে তুলে নেয়া হয়েছে। সিসি ফুটেজ পর্যালোচনা করে প্রাইভেটকারের চালক আলাউদ্দিনকে আটক করে খিলক্ষেত থানা পুলিশ। তাকে ১ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আলাউদ্দিন পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি উবারে প্রাইভেট কার চালান। ৬ মার্চ বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন যাত্রী নিয়ে। ফেরার পথে তিনি অ্যাপস বন্ধ করে দেন। পথে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অপারেশনে যাওয়ার কথা বলে তাকে বাধ্য করে ৪ জন। তাদের কাছে হ্যান্ডকাফ, ডিবির পোশাক ও অস্ত্র ছিল। নিকুঞ্জ-২ এর ৮ নম্বর রোডের পূর্ব পাশে তারা গাড়ি রাখে।
এরপর নীল শার্ট পরা একজন গাড়ি থেকে চলে যায়। অন্যরা গাড়ির আশপাশে অবস্থান করতে থাকে। ঘণ্টা খানেক পর ওই ব্যক্তি (সোহেল) ওই সড়ক দিয়ে হেঁটে আসতেই তারা তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে।
একপর্যায়ে তাকে (সোহেল) রাস্তায় ফেলে দিয়ে এরা গাড়ি নিয়ে আবার নিকুঞ্জ এলাকায় আসে। পেট্রলপাম্পের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ও অন্যান্য কাগজপত্রের ফটোকপি নিয়ে যায়।
যাওয়ার সময় বলে যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি নিয়ে গেলাম, কাউকে কিছু বললে তোকে তুলে নিয়ে খুন করে ফেলব। এরপর বাড়তি ঝামেলার ভয়ে আমি আর কারও কাছে এ বিষয়ে কথা বলিনি। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে নীল শার্ট পরা ওই তরুণকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাকে ধরিয়ে দিতে সবার সহযোগিতা চেয়েছে থানা পুলিশ।
খিলক্ষেত থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আমরা অপরাধী চক্রকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আশরাফুল ইসলাম বলেন, চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নীল শার্ট পরা ওই তরুণকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তার নাম রনি, তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, অপরাধ চক্রের সদস্যরা দিনে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আশপাশে এভাবে ওতপেতে থাকে।
এদের কেউ লেনদেনকারীকে অনুসরণ করে, কেউ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়ার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে অর্থকড়ি কেড়ে নেয়। আবার টাকা তুলে ফেরার পথে একই কায়দায় তুলে নিয়ে অর্থকড়ি ছিনিয়ে নেয়। এ চক্রের সদস্যদের কোমরে পিস্তল ও হাতকড়া, পকেটে ওয়াকিটকি, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা থাকে। গায়ে থাকে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেট।
একজন আরেকজনকে সম্বোধন করে স্যার বলে। দেখে কারও চেনার উপায় থাকে না এরা ভুয়া। ফলে খোদ রাজধানীতেই ঘুরে বেড়ায় এ চক্রের সদস্যরা। কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুললে পুলিশ পরিচয় দিয়ে টাকার উৎস জানতে চায়। একপর্যায়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। গন্তব্য ডিবি কার্যালয় নয়। নির্জন কোনো স্থানে নিয়ে টাকা রেখে ছেড়ে দেয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এ ধরনের অপরাধ চক্রের অন্তত ৪০টি গ্রুপ রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অপকর্ম করে বেড়ায়। প্রতি গ্রুপে ৪ থেকে ৫ জন সদস্য থাকে। এরা কখনও ছিনতাই করা গাড়ি আবার কখনও ভাড়ায় চালিত গাড়ির চালককে জিম্মি করে অপরাধ সংঘটিত করে।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর আছে। ভুয়া পুলিশ ও ডিবি পরিচয়দানকারী অপরাধীদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আমরা সাম্প্রতিককালে এ রকম একাধিক আসামিকে গ্রেফতার করেছি। মানুষ যখন ব্যাংক থেকে টাকা তোলে, তখন ছদ্মবেশে দু-একজন নজরদারি করে কে কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে যাচ্ছে।
সে তার দলের লোকদের মোবাইলে ওই লোকের লোকেশন জানিয়ে দেয়। তখন চক্রের সদস্যরা কখনও ডিবি পুলিশের অভিনয় করে লোকজনকে ঠেক দেয়। এদের কাছে লাঠি, চাকু ও খেলনা পিস্তল থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে দু-একটা ঘটনাতে আসল আগ্নেয়াস্ত্রও থাকে। আমরা সম্প্রতিককালে ৪ জনকে গ্রেফতার করেছিলাম।
তাদের কাছে বিদেশি তিনটা পিস্তল উদ্ধার করেছিলাম। এসব ঘটনা দিন দিন বাড়তেই থাকে। এদের গ্রেফতারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপকর্ম শুরু করে। ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তুলে নিরাপদে ফিরতে পুলিশের মানি অ্যাসকর্ট সার্ভিস নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, অপরাধীরা নানা পরিচয়ে অপরাধ সংঘটিত করে।
আমরা প্রতিনিয়ত এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি। তিনিও অপরাধ চক্রের শিকার থেকে রেহাই পেতে সচেতনতার প্রতি গুরুত্ব দেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসয