বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না রাজস্ব আহরণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের ঘরে। সরকারের রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্কের মতো পরোক্ষ খাত থেকে। প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে বাকি ৩০ শতাংশ। আবার প্রত্যক্ষ করের ৮৫ শতাংশই আসে উৎসে কর কর্তন ও অগ্রিম কর থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত দেশের মানুষের বড় একটা অংশ করজালের বাইরে থাকায় তাদের কাছ থেকে রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আয়কর আহরণ ও আদায় পদ্ধতি ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় করদাতারাও আয়কর প্রদানে খুব একটা আগ্রহী নন। ফলে ব্যয় মেটাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। আর প্রত্যক্ষ কর যেটুকু আহরণ হয়, তা-ও অনেকাংশে উৎসে কর্তননির্ভর।
উৎসে কর কর্তন বা টিডিএস হচ্ছে দেশের জনগণের কাছ থেকে আয়ের বিভিন্ন উৎস ও সেবা প্রদান পর্যায়ে কর আদায় করার পরোক্ষ উপায়। বেতন ছাড়াও কমিশন, ব্রোকারেজ, রয়্যালটি পেমেন্ট, চুক্তির ভিত্তিতে পরিশোধ, একাধিক আর্থিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আয়কৃত সুদ বা মুনাফা, পেশাগত ফি ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ কর কর্তন প্রযোজ্য হয়।
সরকারের আহরিত প্রত্যক্ষ করের সর্বশেষ বিস্তারিত চিত্র পাওয়া গেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই অর্থবছরে সংস্থাটি ২ লাখ ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা বা মোট আহরিত রাজস্বের ৭০ শতাংশই এসেছে পরোক্ষ কর থেকে। আর বাকি ৬২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা বা ৩০ শতাংশই এসেছে প্রত্যক্ষ কর থেকে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে এনবিআর আয়কর খাতে যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করেছে, তার বড় অংশই এসেছে উৎসে কর বাবদ। ওই অর্থবছরে বৃহৎ কয়েকটি খাত থেকে এনবিআর ৬১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা প্রত্যক্ষ কর বাবদ আদায় করেছে। এর মধ্যে উৎসে করের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা, যা প্রত্যক্ষ কর বাবদ আহরিত মোট রাজস্বের ৬১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা এসেছে ৬৪ ধারায় প্রদত্ত অগ্রিম আয়কর বাবদ, যা মোট আহরণকৃত প্রত্যক্ষ করের ২৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মাত্র ৫ হাজার ৯৯ কোটি টাকা এসেছে ৭৪ ধারায় রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর বাবদ, যা মোট আহরণকৃত করের মাত্র ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ১৯ শতাংশ। কোম্পানি ব্যতীত আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, যা মোট আহরণের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এছাড়া বেতন থেকে ২৯৯ কোটি, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি থেকে ৪৭২ কোটি এবং অন্যান্য খাত থেকে আহরণ হয়েছে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা।
রাজস্ব বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যক্ষ করে উৎসে আয়করের অবদান বেশি হওয়াটা তিনটি বিষয় ইঙ্গিত করে। প্রথমত, যেহেতু বহু মানুষ করের আওতায় নেই, সেহেতু কেউ যদি ব্যাংক হিসাব বা এফডিআর খোলে, তাত্ক্ষণিকভাবে তার কাছ থেকে যা নিতে পারে তা-ই সরকারের লাভ। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ব্যাংকে লেনদেন, এফডিআরে রাখা অর্থ, আমদানি—এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎসে কর আহরণ বাড়ায় সরকার।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, কর দেয়া এবং নেয়ার পদ্ধতি, যেটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ। কাগজপত্র যথাযথভাবে পূরণ এবং এ যথার্থতা নিশ্চিত করে কাগজপত্র সংগ্রহ, কর দেয়া এবং নেয়া—দুই পক্ষই এ ধরনের ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঝামেলাবিহীন উৎসে কর পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অস্পষ্ট অর্থনীতি। যেখানে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স নেই, সেখানে উৎসে করই ভালো। কারণ এতে কোনো ব্যয় নেই। একজন করদাতার থেকে ফাইল নিতে গেলে তার পেছনে ব্যয় ও শ্রম দিতে হয়। কিন্তু উৎসে করে কোনো ব্যয় নেই। যিনি দিচ্ছেন তার কোনো খরচ নেই, আবার যিনি নিচ্ছেন, তারও কোনো খরচ হচ্ছে না।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, এক্ষেত্রে ঝুঁকি হলো প্রকৃত করদাতারা করের আওতায় আসছে না, পার পেয়ে যাচ্ছে। যেহেতু করদাতার কোনো ফাইল নেই, সেহেতু তার কাছ থেকে আদায় করা উৎসে কর বিবিধ হিসাবে জমা হচ্ছে। এ বিবিধ ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি জটিল ও কঠিন হয়ে যায়। উৎসে কর কাটা ও দেয়ার পদ্ধতি উভয়পক্ষের কাছে
সহজ মনে হলেও এ পদ্ধতিতে দুই পক্ষেরই জবাবদিহিতার ক্ষেত্র প্রায় শূন্য। কারণ এ করের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা সীমিত। এটি অর্থনীতির ঝুঁকি বাড়ায়। অর্থাৎ যে অর্থনীতিতে করদাতার সংখ্যা কম, অস্পষ্টতা আছে, হিসাব ঠিকমতো রাখা হয় না, কর আহরণকারী দপ্তরের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকে না, আইন সহজ করা বা জটিলতা কাটানোর কোনো সদিচ্ছা থাকে না এ ধরনের পরিস্থিতিতে উৎসে কর থেকে কর আহরণ বাড়ে।
এনবিআরের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎসে আয়করের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে কন্ট্রাক্টর বা সাবকন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে। টাকার অংকে এর পরিমাণ ৮ হাজার ২০৪ কোটি, যা উৎসে কর্তন থেকে আহরিত মোট আয়করের ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আমদানিকারকদের কাছ থেকে আহরণ হয়েছে ৭ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা, যা মোট আহরিত উৎসে করের ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে উৎসে কর্তন বাবদ ৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা আহরণ করেছে এনবিআর, যা মোট আহরণের ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সম্পত্তি হস্তান্তর খাত থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার, টেরি টাওয়েল, পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, শাকসবজি, চামড়াজাত পণ্য, মোড়কজাত খাদ্য রফতানি বাবদ আয়কর এসেছে ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বেতন থেকে উৎসে আয়কর বাবদ আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অন্যান্য খাতে আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। লভ্যাংশ থেকে উৎসে আয়কর বাবদ আহরণ হয়েছে ১ হাজার ১২ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭১ শতাংশ। তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার, টেরি টাওয়েল, পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, শাকসবজি, চামড়াজাত পণ্য ও মোড়কজাত খাদ্য ব্যতীত অন্যান্য পণ্যের রফতানি বাবদ উৎসে আয়কর এসেছে ৯৩০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অনিবাসীদের আয়ে উৎসে কর্তন বাবদ আহরণ হয়েছে ৯০৯ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
চার কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশে আয়কর দেন ২১ লাখ থেকে ২২ লাখ নাগরিক। এ সংখ্যা খুব শিগগিরই এক কোটিতে নিয়ে যেতে চায় সরকার। আয়কর খাতে রাজস্ব বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে ফল পাচ্ছে না এনবিআর। দেশে বর্তমানে ৪৬ লাখের বেশি ই-টিআইএনধারী থাকলেও সর্বশেষ আয়কর মেলায় রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ২২ লাখেরও কম। অর্থাৎ ই-টিআইএনধারীর বড় অংশই তাদের আয়কর বিবরণী জমা দেননি। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যয় মেটানোর জন্য পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ করের হার কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়ায় অনেকেই করজালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য করা হচ্ছে।
পরোক্ষ করের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করের তুলনা করা সমীচীন হবে না বলে মনে করেন সম্প্রতি অবসরে যাওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (আয়কর) কানন কুমার রায়। তিনি বলেন, প্রত্যক্ষ করের ব্যয়ের বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, আমাদের ব্যয় সবচেয়ে কম। পরোক্ষ কর হচ্ছে কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাট এগুলো। পরোক্ষ কর তো সরাসরি দেয়া হয় না। কেউ একটা পণ্য ক্রয় করল, সে সময় তাকে ওই করটা পরিশোধ করতে হয়। এটা কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দেয়া হয়নি।
রাজস্ব আহরণে হিস্যার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রত্যক্ষ কর আহরণেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে সরকারের। এনবিআরের হিসাব অনুসারে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০০ টাকা প্রত্যক্ষ কর আহরণের বিপরীতে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ৭৫ পয়সা। যেখানে একই সময়ে পরোক্ষ কর আহরণের ক্ষেত্রে পুরস্কার, ব্যান্ড রোল ও স্ট্যাম্প মুদ্রণ ব্যয়সহ প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে প্রশাসনিক ব্যয় হয়েছে ৫০ পয়সা।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যক্ষ কর যারা দিচ্ছেন, তাদের পেছনে প্রশাসনিক ব্যয় বেশি। পরোক্ষ কর যারা দিচ্ছেন, তাদের প্রতি প্রশাসনিক ব্যয় কম। কারণ লোকবলের দিক থেকে তো প্রত্যক্ষ অনেক বেশি; পরোক্ষ করের চেয়ে। বলা চলে দ্বিগুণ। পরোক্ষ করের প্রশাসনিক দপ্তরও কম। দেশে আয়করের অফিস সংখ্যা যেখানে ১ হাজার ১০০টি, সেখানে পরোক্ষ করের অফিস সংখ্যা মাত্র ২০০।
দেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় নানা অসামঞ্জস্য রয়েছে জানিয়ে তা দূর করার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। হাতে সময় মাত্র তিন বছর। এর মধ্যে রেভিনিউ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক, ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক সবই স্ট্রিমলাইন করতে হবে। এখনো ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য ৫০ পাতা পূরণ করতে হয়, এলসি খোলার জন্য অনেকগুলো স্বাক্ষর লাগে, এ বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি রাজস্বের রেগুলেটরি কাঠামো যত দ্রুত সম্ভব হালনাগাদ করা প্রয়োজন। কারণ আপনি যদি একটা নতুন ব্যবসা খোলেন অথবা আপনার ব্যবসা যদি মাঝারি আকারের হয়, সে অবস্থায়ও যখন আপনাকে মুনাফার চেয়ে বেশি সুদ ও কর-মূসক বাবদ ব্যয় করতে হয়, তখন বুঝতে হবে এখানে সিস্টেমে কোনো সমস্যা আছে। কারণ আপনি ব্যবসাটাকে স্কেল-আপ করতে দিচ্ছেন না। স্কেল-আপ না করলে প্রফিট হচ্ছে না। প্রফিট না হলে পুনর্বিনিয়োগও হচ্ছে না অর্থাৎ কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। এর মানেই হলো গোটা ব্যবস্থাটিতে কোনো সমস্যা আছে, আর সিস্টেমটি ২০ থেকে ৩০ বছরের পুরনো।
বাংলা৭১নিউজ/এমকে