মনুু নদী সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ‘কাশিমপুর পাম্প হাউজ’ সংস্কার কাওয়াদীঘি হাওর ও হাওর কড়াইয়া এলাকার কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। গত তিন বছরে এসব হাওর এলাকার কৃষকরা বোরো ধানের পাশাপাশি আমন-রূপা ধানেরও আবাদ করেছেন। এছাড়াও পাম্প হাউজ সংস্কারের ফলে পানিতে ডুবে থাকা প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমি আমন ধান চাষের আওতায় এসেছে। যেখানে ৩৫ হাজার মেট্রিক টনেরও অধিক অতিরিক্ত আমন ধান উৎপাদন হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলা থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে রাজনগর উপজেলাধীন ফতেপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম ‘কাশিমপুর’। কাওয়াদীঘি হাওর এলাকায় এই গ্রামের অবস্থান। ভারতের ত্রিপুরাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেই মৌলভীবাজার জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহমান মনু এবং ধলাই নদীতে আকস্মিক বন্যা দেখা দিত এবং এখানকার নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। অত্র এলাকার মানুষ প্রকৃতির খামখেলালিপনার উপরই সঁপে দিয়েছিল নিজেদের ভাগ্য।
‘মনু সেচ প্রকল্প’- এবং এর আওতায় কাশিমপুর এলাকায় স্থাপিত ‘কাশিমপুর পাম্প হাউজ’ বদলে দিয়েছে এখানকার মানুষের ভাগ্য। হাওর জুড়েই এখন ধান আর ধান। বোরো ছাড়াও রূপা-আমন ধানও হাওরের বিভিন্ন এলাকায় চাষ হচ্ছে। স্থানীয় এলাকাবাসীর মতে, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে ১২ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে হাওরের অর্ধেকেরও বেশি জমি এসেছে দুই ফসলের আওতায়। মূলত কাশিমপুর পাম্প হাউজে স্থাপিত ৮টি পাম্পের মাধ্যমে নিষ্কাশিত পানি ব্যবস্থাই এখানকার মানুষের ভাগ্য বদলে দেওয়ার মূল কারণ। হ্ওারের আরও অধিক পরিমান জমিকে আবাদের আওতায় আনতে সরকারের কাছে অত্র এলাকার মানুষের দাবি আও ৪টি পাম্প স্থাপনের।
কাওয়াদীঘি হাওরে বাড়ছে ধানের চাষ
তবে পরিবেশবাদীদের মতে, হাওরের সব পানি নিষ্কাশন করা হলে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। সেইসাথে এখানকার মৎসজীবীদের জীবন-জীবিকার উপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
মনু প্রকল্পটি কাওয়াদীঘি হাওর এলাকায় অবস্থিত। প্রকল্পের উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে মনু নদী আর পূর্বে ভারতের ভাটেরা পাহাড়। ভারতের ত্রিপুরাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেই মনু এবং ধলাই নদীতে আকস্মিক কন্যা দেখা দেয়। এতে নিচু এলাকায় বছর জুড়েই পানি আটকে থাকতো এবং ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতো। আকস্মিক বন্যা ও আবাদী জমি পানিতে তলিয়ে থাকার কারণে দারিদ্রতা ছিল এখানকার মানুষের নিত্য সঙ্গী।
এই দূরাবস্থা নিরসনে ১৯৬২ সালে মনু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। আর ১৯৭৫-৭৬ সালে মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলা এবং রাজনগর উপজেলার সংশ্লিষ্ট এলাকা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়ে ১৯৮২-৮৩ সালে শেষ হয়। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রকল্প এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রন, নিষ্কাশন ও সেচের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন। প্রকল্পের আওতায় ফসরী জমি থেকে বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য কাশিমপুরে ৮টি পাম্প স্থাপন করা হয়। কেএসবি জার্মানির তৈরি এসব পাম্পের প্রতিটির পানি নিষ্কাশনের কার্যক্ষমতা ১৫০ কিউসেক। এই হিসাবে ৮টি পাম্পের পানি পাম্পিংয়ের ক্ষমতা ১২০০ কিউসেক। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে ওই এলাকায় বছরে গড়ে ২৬ হাজার মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন হতো। এর মধ্যে বন্যায় ৭ হাজার মেট্রিক টন ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হতো। এতে করে ওই এলাকার মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদ্য ঘাটতি থাকতো গড়ে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন। কিন্ত মনু সেচ প্রকল্প ও কাশিমপুর পাম্প হাউজ স্থাপনের পর এই এলাকায় কৃষি বিপ্লব ঘটে। ফসল উৎপাদনের পরিমান এক লাফে চলে যায় ৯৮ হাজার মেট্রিক টনে। বদলে যেতে থাকে এখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মান।
কিন্ত প্রকল্পটি ৪০ বছরের পুরানো হওয়ায় ৮টি পাম্পেরই কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। হাওরবাসীর মাঝে পুনরায় হতাশা দেখা দেয়। ফসল উৎপাদন কমে যায়। অনেক জমি জলাবদ্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে প্রকল্প এলাকায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা নিরসনে সম্পূর্ন সরকারি অর্থায়নে ২০১৬ সালের ১ মে পাম্প প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু হয় এবং ২০১৮ সালের ৩০ জুন কাজ সমাপ্ত হয়। জার্মান থেকে ৮টি পাম্প এনে এখানে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যায় ৮৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা হলেও প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৮২ কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। পাপাম্প প্রতিস্থাপন, পাম্প পরিচালনার জন্য আধুনিক কন্ট্রোল সিস্টেম ও কন্ট্রোল রুম স্থাপন করায় সম্পূর্নভাবে পাম্পগুলো কার্যকর হয়ে উঠে।
মনু নদীর উপর নির্মিত মনু ব্যারেজ
কাশিমপুর পাম্প হাউজ পুনস্থাপন করায় কাওয়াদীঘি হাওড় এলাকায় আগাম বন্যার হাত থেকে বোরো ফসল রক্ষা পায়, পাকা বোরো ধান রক্ষায় হাওড় এলাকার অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে, বন্যার কবল থেকে ফসল ও সম্পদ এবং জানমালের প্রশমিত করা সম্ভব হয়। এছাড়াও অতিরিক্ত ফসল যেমন আমন ও রূপা ধানের চায় এবয় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
কাশিমপুর পাম্প হাউজ কেপিআই স্থাপনা হলেও এর নিরাপত্তায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এখানে নিরাপত্তার জন্য ১১ জন আনসার রাখা হলেও সবাই নিরস্ত্র। এছাড়াও কাশিমপুর পাম্প হাউজে অনুমোদিত সেট আপ অনুযায়ি প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় যথাযথভাবে পাম্প পরিচালনা করাটাও দূরহ হয়ে পড়েছে। এই পাম্প হাউজে কোন স্থায়ী পাম্প অপারেটর নেই। অথচ এখানে পুনর্বাসর প্রকল্প বাস্তবায়ন পরবর্তি আগাম বন্যা ও পাহাড়ী ঢলের পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩ শিফটে ২৪ ঘন্টাই বৃষ্টির পানি সরানোর জন্য ৮টির মধ্যে ৬টি পাম্পই চালু রাখতে হয়। যদিও বর্তমানে পাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভ্রাট একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে হাওরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাম্পের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের কাজ চলে। পুনস্থাপিত পাম্প হাউজ নিয়ে হাওরবাসীর মন্তব্য হচ্ছে- এটি তাদেও জন্য নতুন করে আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য নেসার আহমেদ বলেছেন, নতুন করে ৮টি পাম্প স্থাপন করায় হাওর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে। বাড়তি ফসল উৎপান হচ্ছে। কুষি জমি বেড়েছে। এছাড়াও বোরো মৌসুমে পাকা ধানের সময় ধানক্ষেতে পানি জমলে পাম্প হাউজের মাধ্যমে তা নিষ্কাশন করা হচ্ছে। তিনি এই পাম্প হাউজ যেকোন মূল্যে সচল রাখার বিষয়টি জোড়ালোভাবে তুলে ধরেন।
ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নকুল দাস বলেন, পাম্প হাউজ স্থাপনের পর ৩ বছর যাবত এখানকার কৃষক ভাল ফসল পাচ্ছে। অনেকে অতিরিক্ত ফসলও উৎপাদন করছে। কৃষকের মুখে মুখে এই হাসি ফুটানোর জন্য তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ধন্যবাদ জানান।
কাশিমপুর গ্রামের শতবর্ষী আবদুল কাদির বলেন, এই পাম্প হাউজ আমাদের হাতে হয়েছে। যখন এই এলাকায় পাম্প হাউজ ছিল না, তখন এই এলাকার মানুষের কষ্টের কোন সীমা ছিল না। প্রকৃতির খেয়ালীপনার উপর এখানকার মানুষের জীবনজীবিকা নির্ভর করতো। আমরা হাওড় এলাকার মানুষ এক ফসলও ঠিকভাবে ঘরে তুলতে পারতাম না। অভাব আর দূর্ভিক্ষ ছিল আমাদের নিত্য সঙ্গী। পাম্প হাউজ হওয়ার পর এখানকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। কয়েক বছর আগে পাম্প হাউজ পানি নিষ্কাশনের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে আমাদের এই এলাকায় আবার অভাব-অনটন দেখা দেয়। নতুনভাবে ৮টি পাম্প স্থাপন এই এলাকার কৃষকদের জন্য পুনরায় আর্শিবাদ নিয়ে এসেছে। তিনি হাওরবাসীর স্বার্থে অতিরিক্ত আরও ৪টি পাম্প স্থাপিেনর জোর দাবি জানিয়েছেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি