
দুই বছর ধরে ইসরায়েলের লাগাতার হামলার পর অবশেষে গাজায় কার্যকর হয়েছে যুদ্ধবিরতি। চুক্তি অনুযায়ী গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই ঘোষণার পর ভেঙে পড়া, পোড়া ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা।
বাড়ি বলতে এখন আর কিছু নেই, শুধু ধ্বংসস্তূপ। এরপরও বহু মানুষ ফিরছেন, কারণ তাদের আর কোনো উপায় নেই। ফিরে এসে তারা খুঁজে পাচ্ছেন না খাবার, পানি, বিদ্যুৎ বা আশ্রয়। তবুও ফিরছেন, কারণ বারবার পালিয়ে থাকার জীবনও আর চলে না।
দীর্ঘ আলোচনার পর মিসরের শারম আল শেখ শহরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়। এরপর ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করে এবং শুক্রবার (১০ অক্টোবর) স্থানীয় সময় দুপুরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েল তাদের বাহিনী গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে সরিয়ে নেবে। আর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামাস জীবিত ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এরপর পালাক্রমে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি ১ হাজার ৯৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে।
ফিলিস্তিনি বন্দিদের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। এদের মধ্যে ২৫০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। তাদের মধ্যে রয়েছে ফাতাহ, হামাস, ইসলামিক জিহাদ ও পিএফএলপির সদস্যরাও।
যুদ্ধবিরতির পরই গাজার দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তর অংশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস, নুসেইরাত শরণার্থীশিবির এবং গাজার উপকূলবর্তী এলাকায় সেনা ও ট্যাংকগুলো সরে গেছে পূর্ব দিকে।
অন্যদিকে, এখনো গাজা নগরী ও আশপাশের এলাকায় গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। অনেক জায়গায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার উড়তে দেখা গেছে। ফলে অনেক মানুষ ফিরেও আবার ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
ফিরে আসা ফিলিস্তিনিরা বলছেন, তারা জানেন যে তাদের ঘর নেই, নিরাপত্তা নেই। তারপরও নিজেদের শহরে ফিরে আসাটাই তাদের কাছে কিছুটা শান্তির। মেহেদি সাকলা নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘সব ধ্বংস হয়ে গেছে, জানি। কিন্তু নিজেদের মাটি, তাই ফিরতেই হবে। পালিয়ে থাকাটা আরও ভয়ংকর ছিল।’
গত দুই বছরে গাজায় কী ঘটেছে, তা এখনো বিশ্লেষণ চলছে। জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে একে ‘জাতিগত নিধনের মতো অপরাধ’ বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর, সেদিন থেকেই গাজায় শুরু হয় ভয়াবহ হামলা। এরপর টানা দুই বছর চলে বোমাবর্ষণ, স্থল অভিযান ও অবরোধ। এর মধ্যে মাত্র দুই মাসের কিছু সময় যুদ্ধবিরতি ছিল।
এই সময়ে ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ।
ধ্বংসের মাত্রাও ভয়াবহ। গাজা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ৪ লাখ ৩৬ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে, যা উপত্যকার মোট বসতঘরের ৯২ শতাংশ। ধ্বংস হয়েছে ৫১৮টি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রায় ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
স্বাস্থ্যসেবা অচল হয়ে গেছে। ৬৫৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষিজমির ৯৮ শতাংশ এখন অনুপযোগী।
এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় আশার আলো অনেকটাই অনিশ্চিত। চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল প্রতিদিন গাজায় ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেবে। জাতিসংঘ জানায়, মিসর ও জর্ডানে মজুত রাখা হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টন ত্রাণসামগ্রী।
তবে বাস্তবে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ খুবই সীমিত। যুদ্ধ ও অবরোধের কারণে খাদ্য সংকট চরমে। গত দুই বছরে অনাহারে মারা গেছেন অন্তত ৪৬০ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে ১৫৪ জন শিশু।
যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে গঠন করা হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স। এর নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড। এই টাস্কফোর্সে যুক্ত থাকবে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার, তুরস্কসহ একাধিক মুসলিম ও আরব দেশের সেনাবাহিনী। তবে মার্কিন সেনারা গাজায় প্রবেশ করবে না বলে জানানো হয়েছে।
চুক্তির প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, ভবিষ্যত নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন প্রশ্ন। হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত মানচিত্র অনুযায়ী, তিন ধাপে ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে।
প্রথম ধাপে ৫৩ শতাংশ এলাকা থাকবে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয় ধাপে তা কমে ৪০ শতাংশে নামবে। তবে শেষ ধাপে গাজার ১৫ শতাংশ এলাকায় গড়ে তোলা হবে ‘নিরাপত্তা গণ্ডি’, যেখানে ইসরায়েলি সেনারা অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকবে, এমনটাই বলা হয়েছে।
এই সেনা উপস্থিতির সময়সীমা না থাকায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ চুক্তির দুর্বল দিক হতে পারে।
এদিকে ইসরায়েলের ভেতরে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছেন অনেক উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিক। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির হুমকি দিয়েছেন, হামাসকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না করা হলে তিনি সরকারের জোট ভেঙে দেবেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই মুহূর্তে রাজনৈতিক চাপে রয়েছেন। যুদ্ধবিরতির চুক্তি হলেও, তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান অনিশ্চিত।
অন্যদিকে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেলে সেখানে কাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, সেটিও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সেখানে নতুন করে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করবে। তবে এই বাহিনীতে হামাসের সদস্য থাকবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তির প্রথম ধাপ শেষ হলেও আসল চ্যালেঞ্জ এখন শুরু। গাজা পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ঐক্য এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন—এই তিনটি বিষয়ই সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ হানান আশরাউই এক বিবৃতিতে বলেন, গাজায় যদি যুদ্ধ থেমেও যায়, পশ্চিম তীরে দখলদারি চলতে থাকলে এই সংকটের সমাধান হবে না। এখন প্রয়োজন ফিলিস্তিনি জনগণের ঐক্য এবং দখলদারিত্বের সমাপ্তি।
সূত্র: রয়টার্স ও আল জাজিরা
বাংলা৭১নিউজ/জেএস