৫৩ বছর বয়সী আরান আলি বলেন, “সরকার বারবার আমাদের হয়রানি করছে।
আসামের বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, যিনি বিজেপির একজন আগ্রাসী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত, প্রকাশ্যে বলেছেন, “বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের পরিচয়কেই হুমকির মুখে ফেলছে।” তিনি দাবি করেন, এই অনুপ্রবেশ বন্ধ না হলে রাজ্যের জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাত ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য দেখিয়ে তিনি বলেন, তখন মুসলিম অভিবাসীরা ছিল রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ।
২০১৯ সালে বিজেপি সরকার ভারতের নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) সংশোধন করে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দিলেও মুসলিমদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। ২০২১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে হিমন্ত শর্মার নেতৃত্বে সরকার অন্তত ৫০,০০০ মানুষকে উচ্ছেদ করেছে, যাদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম। শুধু গত এক মাসেই রাজ্যজুড়ে পাঁচটি অভিযানে ৩,৪০০টি মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক প্রভীন দোন্থি বলেন, “বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা, তাদের আইনি অবস্থান যাই হোক না কেন, ভারতে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর জন্য এখন সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে।”
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, তারা ক্ষমতায় ফিরলে এই ধ্বংসযজ্ঞের পুনর্নির্মাণ করবে এবং যারা ঘরবাড়ি ভেঙেছে, তাদের জেলে পাঠাবে। কংগ্রেসের এক আইনপ্রণেতা আকিল গগৈ বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো রাজনৈতিকভাবে লাভজনক, আর তাই বিজেপি এগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে।”
এই উচ্ছেদ অভিযানের প্রেক্ষাপটে ভারতজুড়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিও যুক্ত হয়েছে। কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত, যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। এরপর বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলো নিরাপত্তার অজুহাতে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ আখ্যা দিয়ে আটক করতে শুরু করে।
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার অপসারণের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপড়েন এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কিছু হামলার ঘটনার সুযোগ নিয়ে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে এই ইস্যু কাজে লাগাচ্ছে। হিমন্ত শর্মা প্রায়ই সীমান্তে অনুপ্রবেশ বন্ধের প্রচেষ্টা ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশে “পুশব্যাক” বা জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শত শত মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু মানুষকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ‘বিদেশি’ ঘোষণা নিয়ে আদালতে শুনানি চলছিল। রাজ্য সরকার বলছে, আসামে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার মানুষকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করেছে ট্রাইব্যুনাল। অথচ এদের অধিকাংশই দীর্ঘদিনের বাসিন্দা, পরিবার-জমি-ঘরবাড়ি রয়েছে। অনেকেই এতটাই দরিদ্র যে আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করারও সামর্থ্য নেই।
ভারত সরকার ২০১৬ সালে জানিয়েছিল, দেশে প্রায় ২ কোটি বাংলাদেশি ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে বসবাস করছে। তবে এই পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া পরিচালক ইলায়ন পিয়ারসন বলেন, “অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করার নামে ভারত সরকার হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে। বাস্তবে এটি মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ২,৩৬৯ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে এবং বাংলাদেশের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে যাচাই প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য আসেনি।
বিশ্লেষক প্রভীন দোন্থি বলেন, “আসামে আগে জাতিগত জাতীয়তাবাদ রাজনীতিকে চালিত করত। এখন সেটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে ফোকাস এখন বাঙালি ভাষাভাষী মুসলিমদের ওপর।”
এই পরিস্থিতিতে আসাম এবং ভারতজুড়ে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা নিপীড়নের, দুঃসহ বাস্তবতার এবং একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। ভোটের রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্বকেই যেন পরিণত করা হয়েছে বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে।
বাংলা৭১নিউজ/এবি
উপদেষ্টা সম্পাদক : সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, প্রধান সম্পাদকঃ তাজিন মাহমুদ, সম্পাদক: ডা: সাদিয়া হোসেন, যোগাযোগঃ ৪/এ,ইন্দিরা রোড, মাহবুব প্লাজা (২য় তলা) ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, বাংলাদেশ ।মোবাইল: ০১৯৭১-১৯৩৯৩৪, ০১৫৫২-৩১৮৩৩৯, ই-মেইল: [email protected]; [email protected]। ওয়েব:www.bangla71news.com
© All rights reserved © 2018-2025